একটা সময় ছিল যখন আমাদের সমাজে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষা নিয়ে বেশ গোঁড়ামি ছিল। এখন সবাই নারীদের শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী হলেও তাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে রয়েছে বেশ ধোঁয়াশা। কেউ কেউ মনে করেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর নারীকে একদম ঘরবন্দী করে রাখতে হবে। তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া যাবে না। তারা নারীদের শিক্ষাকে একটা সীমাবদ্ধতায় বেষ্টন করেন। গত ১৮ জুলাই আমাদের সহিহ মুসলিম হাদিসের দরসে অর্ধশত গ্রন্থপ্রণেতা, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাসসির মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন সাহেবকে প্রশ্ন করা হয়েছিল নারীর উচ্চশিক্ষা নিয়ে। হুজুর বললেন, প্রথমত প্রয়োজনীয় শিক্ষা অর্জন করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ফরজ। তারপর কেউ যদি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তাহলে বাধা নেই। তাছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে রাসূল সা: শিক্ষার কোনো সীমাবদ্ধতা রাখেননি। তারা চাইলে শরয়ি বিধিনিষেধ মেনে প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে।’
তাছাড়া আমি মনে করি, যারা বলেন, নারীরা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারবে না। এটা তাদের চিন্তার সঙ্কীর্ণতা। কেননা আমরা জানি অনেক নারী সাহাবিও গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে আম্মাজান হজরত আয়েশা রা:। তিনি ছিলেন হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রের একজন মহান প-িত এবং একজন দক্ষ চিকিৎসক। খলিফায়ে আরবায়াসহ বড় বড় সাহাবিও তাঁর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতেন। হজরত আবু মূসা আশআরী রা: বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূল সা:-এর সাহাবিরা যখনই কোনো মাসয়ালার ব্যাপারে সন্দেহ বা সমস্যায় পড়তাম তখনই আমরা হজরত আয়েশা রা:-এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম এবং সঠিক সমাধান পেয়ে যেতাম (তিরমিজি, মিশকাতুল মাসাবিহ)।
উরওয়া রহ: বলেন, আমি চিকিৎসা বিজ্ঞানে আয়েশা রা: অপেক্ষা দক্ষ মানুষ দেখিনি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, খালা! আপনি এই জ্ঞান কোথা থেকে অর্জন করলেন? তিনি বলেন, আমি মানুষকে রোগীর চিকিৎসা করতে দেখেছি এবং তা মনে রেখেছি (সিয়ারু আলামুন নুবালা : ২/১৮২)।
তাছাড়া বিভিন্ন সময় রাসূল সা: নারীদের জ্ঞানচর্চার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। মদিনার আনসারি নারীদের প্রশংসা করে রাসূল সা: বলেন, ‘আনসারি নারীরা কতই না উত্তম! লজ্জা কখনোই তাদের ধর্মের বিষয়ে জ্ঞানান্বেষণে বিরত রাখতে পারে না’ (মুসলিম : ৭৭২)। রাসূল সা:, খুলাফায়ে রাশেদিন এবং ইসলামের সোনালি যুগে তাকালেই দেখা যায় নারীরা ব্যবসা, কৃষিকাজ, হস্তশিল্প, সমাজসেবা এমনকি রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বেও বিরাট অবদান রেখেছেন। স্বয়ং রাসূল সা: ও খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে ২২ জন নারী সাহাবি মুহাদ্দিস, ফকিহ তথা, আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামী সোনালি যুগে এর উদাহরণ অহরহ।
বিশেষ করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীরা বেশ পারঙ্গম ছিলেন। এমনকি শৈল্যবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন তারা। যুদ্ধে রাসূল সা:-এর সাথে অনেক নারী অংশগ্রহণ করতেন। যারা আহত সৈন্যদের চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত থাকতেন। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত, উম্মে সুলাইম রা: ও তাঁর সঙ্গের আনসার নারীদের নিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা পানি পান করাতেন এবং আহতদের জখমে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন (সুনানে আবি দাউদ : ১৫৭৫)।
সুতরাং বর্তমান যুগে যারা নারীদের উচ্চশিক্ষা থেকে নিরুৎসাহিত করেন তারাও কিন্তু তাদের স্ত্রীদের ডাক্তার দেখাতে গেলে মহিলা ডাক্তার খোঁজেন। এখন যদি নারীদের উচ্চশিক্ষা করতে বাধাই দেয়া হয়, তাহলে নারী ডাক্তার কিভাবে তৈরি হবে? নারীদের এমন অনেক বিষয় থাকে যা সাধারণ পুরুষ ডাক্তারের কাছে বলতে লজ্জাবোধ করেন। এ ক্ষেত্রে যদি নারী ডাক্তার হয় তাহলে দ্বিধা বা লজ্জাবোধ কিছুরই আশঙ্কা থাকে না।
তাই আমরা বলব, যদি কোনো নারী সম্ভ্রম রক্ষা করে শরয়ি বিধিবিধান মেনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চান তাহলে অবশ্যই তিনি যেকোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারেন। লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রাবাড়ী, ঢাকা