শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩০ অপরাহ্ন

শিক্ষকের বেতনভাতা এবং মর্যাদা

তন্ময় কুমার হীরা
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩

শিক্ষকদের, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনভাতা এবং মর্যাদা নিয়ে কথা হচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন আমাদের দেশে কম। অর্থ মান নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি না হলেও একটি মাপকাঠি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেতনভাতা বৃদ্ধি নিয়ে শিক্ষকরা দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসছেন।
শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি মূলত আন্দোলনের বিষয় নয়। এটি একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জাতীয়ভাবে আমরা সেই আকাঙ্ক্ষাটি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আন্দোলনের ফলে বেতনের গ্রেড দুই-একটা বাড়ানো গেলে স্বল্প বেতনভুক্ত শিক্ষকদের একটু সুবিধা হয় বটে। কিন্তু জাতীয় কল্যাণ আরো বড় বিষয়। তার জন্য দরকার শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানো। বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। অথবা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তাতে বেতন হবে নবম গ্রেডের। যারা আগে থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারা বেতন গ্রেড বৃদ্ধির কোনো একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সাপেক্ষে নবম গ্রেডের বেতন পাবে। এতে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হবে। সমস্যা হচ্ছে সরকারি কলেজ-শিক্ষকের পদসংখ্যা এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পদসংখ্যা এক নয়। প্রাথমিকে পদসংখ্যা ঢের বেশি। সরকারি কলেজের প্রায় ১৫ হাজার প্রভাষক পদের জন্য বেশি বেতন নির্ধারণ করা যত সহজ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন লক্ষাধিক শিক্ষকের জন্য বেশি বেতন নির্ধারণ করা রাষ্ট্রের জন্য তত কঠিন। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু রাষ্ট্রকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে কেবল রাষ্ট্রের কল্যাণে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের কল্যাণে। নাগরিকদের কল্যাণে রাষ্ট্র প্রাথমিক শিক্ষাকে ইতিমধ্যেই বাধ্যতামূলক করেছে; অবৈতনিক করেছে। এসবও কিন্তু কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। নাগরিকদের কল্যাণে রাষ্ট্র নতুন যুগের এই নতুন চ্যালেঞ্জকেও নিতে পারবে বলে আশা করি। ব্যাংক খাতে ঐচ্ছিক খেলাপি ঋণের সংখ্যা কমিয়ে বা শূন্যে নামিয়ে, পরিবেশবিরোধী কর্মকা- রুখতে ‘কার্বন কর’ চালু করে, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের ওপর অধিক হারে শুল্ক আরোপ করে, বিলাস পণ্যের ওপর অধিক কর আরোপ করে রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই রাজস্ব শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এবার আসি শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সামাজিক মর্যাদার কথা বলি। সমাজের শিক্ষকদের মর্যাদা বেশি না। মানে লোকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খুব একটা যে দাম দেয় তা নয়। আমার মতে, সমাজ প্রধানত তিন কারণে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া থেকে বঞ্চিত রাখে। এর মধ্যে প্রথম দুটি অযৌক্তিক এবং তৃতীয়টি পুরোপুরি যৌক্তিক। প্রথমত, আমজনতা ‘দুই পয়সার মাইনে’ পাওয়া লোকদের খুব একটা দাম দিতে চায় না। সাধারণ জনতা অর্থের মানদ-ে জগতের প্রায় সবকিছুকেই মূল্যায়ন করতে চায়। শিক্ষকতাও তাদের এই মূল্যায়ন মানদ-ের বাইরে নয়।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, সাধারণ মানুষ এবং কথিত শিক্ষিত মানুষ মনে করে, শিক্ষকদের সমাজে আসলে কোনো ক্ষমতা নেই। যেমন পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা জেলা প্রশাসক। এদের প্রত্যেকের শক্তি মূলত বাহ্য শক্তি। আন্তঃশক্তি রয়ে যায় অগোচরে। একজন শিক্ষক ভিতর থেকে একজন ব্যক্তিকে পালটে দেয়। এই পরিবর্তন তুলনামূলক স্থায়ী ও কার্যকর। আগে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া হতো। এখনো দেওয়া হয় কিন্তু আগে থেকে কম এবং বাহ্য শক্তি প্রয়োগ শিক্ষকদের জন্য এখন নিষিদ্ধ। শিক্ষকদের কাজ আন্তঃশক্তি নিয়ে। ভেতর থেকে পরিবর্তন করা শিক্ষকদের কাজ। এবং এটাও শক্তি বা ক্ষমতা। এই শক্তি খালি চোখে দেখা যায় না। সমাজে জ্ঞানচর্চা বাড়লে, শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং সমাজে শিক্ষকদের বা শিক্ষকতার মর্যাদাও বাড়বে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, প্রথাগতভাবে সমাজে শিক্ষকদের অবদান! সাধারণ মানুষ প্রথাগতভাবেই সবকিছু দেখে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে সমাজ শিক্ষকদের যে রূপ দেখে এসেছে শিক্ষকদের তারা সেই রূপেই বিচার করে। যেমন আমি একজন শিক্ষক। কিন্তু আমি সমাজের জন্য এবং দেশের জন্য এমন কী করেছি যার জন্য লোকে আমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে? ফলে একজন ‘প্রাইমারির মাস্টার’ হিসেবে লোকে যে আমাকে শ্রদ্ধা করে না এটা একদমই ঠিক কাজ করে। ভাগ্যিস, ‘শিক্ষকতা একটি মহান পেশা’ এই স্লোগান সমাজে আগে থেকেই চালু ছিল। ওটা দিয়েই চলছি এখনো। নইলে সংকট আরো বেড়ে যেত।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com