শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন

ডেঙ্গুর অপ্রতিরোধ্য দাপট

নাসরীন মুস্তাফা
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টি, তাপমাত্রা আর অপরিকল্পিত নগরায়ণের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে এডিস ইজিপটি নামের এক ধরনের মেয়ে মশা দাপটের সাথে ডেঙ্গু নামের ভাইরাল জ্বর ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সাথে ছড়াচ্ছে চিকনগুনিয়া, হলুদ জ্বর আর জিকা সংক্রমণ।
চীনের জিন শাসনামলের (২৬৫-৪২০ খ্রিষ্টপূর্ব) একটি মেডিকেল এনসাইক্লোপেডিয়াতে ডেঙ্গু জ্বরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত এটাই ডেঙ্গু জ্বরের প্রথম উল্লেখ। উড়ন্ত পতঙ্গ ‘পানিবাহিত বিষ’ ছড়িয়ে এই জ্বর বাঁধায় বলে বলা হয়েছিল। ১৭৮৯ সালে বেঞ্জামিন রাশ রোগটিকে চিহ্নিত ও নামকরণ করার ঠিক পর পরই ডেঙ্গুর প্রথম মহামারি ছড়িয়েছিল ১৭৮০ সালে, একই সাথে এশিয়া-আফ্রিকা আর উত্তর আমেরিকাতে। তখনো সব মানুষের ভেতর ভয় ছড়িয়ে পড়েনি। মিডিয়ার বিস্তার লাভের কারণে ১৯৫০ সালে ফিলিপাইন আর থাইল্যান্ডে ডেঙ্গু জ্বরটি আতঙ্ক ছড়িয়ে নজরে এসেছিল। এখনো ডেঙ্গু বেশিরভাগ এশিয়ার আর লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১২৮টি দেশের প্রায় চার বিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসের হুমকিতে আছে। সদস্য দেশগুলো এই সংস্থাতে নিয়মিত আক্রান্তের সংখ্যা জানিয়ে রিপোর্ট করছে এবং তাতে জানা গেছে, প্রতিবছর আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, প্রতিবছর ডেঙ্গুর তীব্রতাও বাড়ছে, বদলে যাচ্ছে লক্ষণ এবং এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্য এবং জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়ছে উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া। দেশে দেশে ভ্রমণে যাওয়া ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মানুষের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে রোগটি। যত দিন যাচ্ছে, তত বেশি ছড়াচ্ছে। ১৯৭০ সালের আগে মাত্র নয়টি দেশে তীব্র ডেঙ্গু আক্রমণের ঘটনার কথা জানা ছিল। এখন আফ্রিকা-আমেরিকা-পূর্ব ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ এশিয়া-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার একশটি দেশে ডেঙ্গু তীব্র আতঙ্কের নাম। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৫ সালে কেবল আমেরিকাতেই ২.৩৫ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল, এর মধ্যে ১০,২০০টি কেস ভয়াবহ হিসেবে ধরা পড়েছিল, মৃত্যু বরণ করেছিল ১,১৮১ জন। ২০১০ সালে ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়াতে প্রথম ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে রোগটি। ম্যালেরিয়ার পরে এই ডেঙ্গুকেই ধরা হচ্ছে কষ্টদায়ক জ্বরের উৎস হিসেবে।
২০১৭ আর ২০১৮ সালে আমেরিকাতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে গেলেও জিকা ভাইরাসের আক্রমণ বেড়ে যায়। কেন এমন হলো, তার ব্যাখ্যা বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো দিতে পারেনি। আবার এই কমে যাওয়ার তীব্রতা কেন আবার বেড়ে ২০১৯ সালে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করল, তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। ২০১৯ সাল ডেঙ্গু জ্বরের তীব্রতা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে আমরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি এর আতঙ্ক। অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কঙ্গো, তানজানিয়াÑ মোট কথা এশিয়া-আফ্রিকা-আমেরিকা-ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। ফিলিপাইনের যেসব এলাকায় ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়েছে, সেসব এলাকায় জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো কোনো দেশ ডেঙ্গু আতঙ্ক সামলাতে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলেও বৈশি^ক বিচারে দক্ষতার মান হতাশাজনক। বাংলাদেশেই আমরা দেখছি, মশা মারা ঔষধ কাজ করছে না, ডেঙ্গু রোগ হলো কি না তার পরীক্ষা করতে এবং হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে সমস্যায় পড়ছে রোগী। একের পর এক হাসপাতালে ছুটছে রোগীর স্বজনরা, ভর্তি করাতে পারছে না। চিকিৎসকরা প্রচন্ড পরিশ্রম করেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের মহামারিকাল, ততদিন পর্যন্ত কীভাবে এই সমস্যা সামাল দেওয়া যাবে, সেটাই দুঃশ্চিন্তার বিষয়।
এডিস ইজিপটি মশা ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক বাহক, ভাইরাসবাহী স্ত্রী মশা মানুষকে কামড়ে রক্ত চুষে নিলে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ভাইরাসবাহী মানুষের রক্ত যে মশা পান করবে, সেও হয়ে যাবে বাহক। এই মশার শরীরে ৪ থেকে ১০ দিন ভাইরাসটি সুপ্তাবস্থায় থাকার পর মশাটি তার বাকি জীবনে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে সক্ষম থাকে। আর ভাইরাসবাহী মানুষটি নিষ্পাপ থাকা এডিস মশাদের শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। খুব সকালে আর সূর্যাস্তের আগে আগে মশার রক্তপানের হার বেড়ে যায়। ভাঙ্গা আসবাবপত্র, ফেলে দেওয়া গাড়ির টায়ার, জমানো ক্যানের পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। আবার শুকনো জায়গাতেও বছর ধরে টিকে থাকতে পারে ডিম, পানি পেলেই পেয়ে যায় রোগ ছড়ানোর সুযোগ।
এশিয়ার সেকেন্ডারি ডেঙ্গু ভাইরাস বাহক এডিস আলবোপিকটাস উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের ২৫টিরও বেশি দেশে ছড়িয়েছে ব্যবহৃত টায়ার এবং সৌভাগ্য এনে দেওয়া বাঁশগাছের মতো পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারণে। এডিস আলবোপিকটাস ইউরোপের ঠান্ডার মধ্যে বেঁচে থাকতে সক্ষম, অন্যদিকে এডিস ইজিপটি গরম আবহাওয়ায় উপযুক্ত। এর অর্থ পরিষ্কার। গরম বা ঠান্ডা, কোনো অঞ্চলই আর নিরাপদ নেই। আর সত্যটা এরকম, ডেঙ্গু জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। ডেঙ্গুর টিকা ডেঙ্গভাক্সিয়ার লাইসেন্স ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া হয়, বিশে^র ২০টি দেশে ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সিদের জন্য ব্যবহার শুরু হয়। ২০১৬ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবার্তা জারি করে টিকা ব্যবহার বিষয়ে। সন্দেহ হলেই টিকা দিয়ে নিশ্চিত থাকা যাচ্ছে না, কেননা টিকা দিলে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত নন এমন রোগীর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় শতকরা ৭০ ভাগ। আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ শতভাগ বুঝতে পারা, আক্রান্ত থেকে অ-আক্রান্ত রোগীকে বেছে আলাদা করার শতভাগ সক্ষমতা অর্জনের কাজ এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
করণীয় কী তবে? সরকারি প্রচারণা থেকে স্পষ্ট, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে এডিশ মশাকে ডিম পাড়তে না দেওয়ার কাজটা খুব জরুরি। কেবল জমে থাকা পানি ফেলে দিলেই চলবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সলিড ওয়েস্ট ঠিকঠাকভাবে সরিয়ে নিতে হবে। এতে মানুষের তৈরি করা মশার ডিম পাড়ার উপযোগী কৃত্রিম প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা সহজ হবে। শুকনো জায়গাতেও যে মশার ডিম টিকে থাকে বছর ধরে! দিনের বেলায় হাত-পা ঢেকে রাখা জামা পরা, জানালায় নেট লাগানো, এসব কাজও জরুরি। গণসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া দরকার। এ বছর বেঁচে গেলাম তো ভুলে গেলাম, তা চলবে না। মনে রাখতে হবে, প্রতিবছর রোগের তীব্রতা বাড়ছে। আগামী বছরের প্রস্তুতি নিতেই হবে এখন থেকেই। মনে রাখতে হবে, হুট করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। বিশ শতকে ম্যালেরিয়া ঠেকাতে মশা মারতে ডিডিটির ব্যবহার বেড়ে গেল, যার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বহন করতে হয়েছে পরিবেশকে, তথা মানুষকে। সম্প্রতি পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে আবারো ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে এবং ম্যালেরিয়ার সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রয়োগের পরও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। মশারা মানুষের সর্বোচ্চ চিকিৎসা-সক্ষমতাকে হজম করতে শিখে গেছে। কেন এমন হচ্ছে? মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির বিধ্বংসী রূপ কেবল সাইক্লোন-বন্যার মাধ্যমে নয়, রোগবালাই দিয়েও প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ-ব্রাজিলের মতো উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে নেচার মাইক্রোবায়োলজি পত্রিকায়। গবেষণাপত্রটির সহলেখক লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অলিভার ব্রান্ডি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামী বছরগুলোতে আরো বেশি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হবে।
অলিভার ব্রান্ডি এবং তাঁর সহকর্মীরা মশার আচরণ আর মানুষের নগরায়ণের বিস্তার নিয়ে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে সারা বিশে^র মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছেন এরকম, ২০১৫ সালে যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন, ২০৮০ সাল নাগাদ তার চেয়ে অতিরিক্ত ২ বিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে থাকবে। এই মানুষগুলো কিন্তু আমাদের সন্তান-সন্ততি-নাতিপুতি। নিজের জান বাঁচানোর তাগিদে অস্থির আমরা ভাবছি না পৃথিবীর যে হাল হচ্ছে, তাতে ওরা বাঁচবে কীভাবে? এরকমটি ভাবেননি আমাদের বৈশি^ক পূর্বপুরুষরাও। সচেতনতা ছিল না তাদের। আমাদেরও কি নেই? আছে বলে ভরসা পাচ্ছি না। এখনো বিশে^র সবাই কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যতে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তে একমত হতে পারেনি। কবে হবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকবে আর আমরা ডেঙ্গু রোগ থামিয়ে দেওয়ার জাদুকরকে খুঁজতে থাকব, তা তো হয় না। পিএলওএস নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজেজ শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত আরেক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এরকম প্রাণঘাতী রোগের সংখ্যা আরও বাড়বে। কত জাদুকর পাব আমরা? লেখক: কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com