গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে হওয়া অভিযুক্তি শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। এই শুনানিই ট্রাম্পের প্রথম কোর্টরুম অভিজ্ঞতা ছিল না। এ বছরেই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপন নথির অপব্যবহারের অভিযোগ ফেডারেল কোর্টে আনা হয়েছে। সঙ্গে ২০১৬ সালের নির্বাচনি প্রচারণার সময় অ্যাডাল্ট চলচ্চিত্র অভিনেত্রী স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ঘুষ প্রদানে জড়িত থাকার জন্য নিউ ইয়র্কে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ট্রাম্পের পুনরায় অভিযুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি আসলে এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে কোনোভাবেই ছোট করে না। কেননা, এখন পর্যন্ত সমস্ত অভিযোগের মধ্যে নিশ্চিতভাবে এবারের অভিযোগটাই সবচেয়ে গুরুতর। সরকারকে প্রতারণা করার ষড়যন্ত্র, একটি সরকারি দাপ্তরিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভোটারদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অধিকার হরণ করতে চেষ্টা করাÍএই চার অপরাধের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন ট্রাম্প।
একটি বৈধ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং সেই ফলাফল সক্রিয়ভাবে ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করে ট্রাম্প অ্যামেরিকার গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। গোপন নথির অপব্যহারসহ নতুন এই অভিযুক্তির মাধ্যমে দেশটির বিচার বিভাগের সাবেক রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড ফোর্ডের প্রতিষ্ঠিত নজির ভেঙে দিয়েছে। ১৯৭৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড ফোর্ড সাবেক রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে ওয়াটারগেটে সংঘটিত যে কোনো অপরাধের জন্য ক্ষমা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস যখন অভিশংসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জবাবদিহিতা দাবি করে, নিক্সনকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দেয়, ফোর্ড তখন জোর দিয়ে বলেছিলেন, যে কোনো ব্যক্তি, এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতিও আইনের ঊর্ধ্বে নন।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ট্রমা থেকে অ্যামেরিকানদের নিরাময় করার প্রয়াসেই মূলত ফোর্ড এই ক্ষমা জারি করেছিলেন। অন্যথায়, একটি দীর্ঘ আইনি বিচার প্রক্রিয়া কলঙ্কজনক অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে ভোটারদের টেনে নিয়ে যেত। জবাবদিহিতা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ঐ মুহূর্তে সামনে এগিয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্তত ফোর্ড তাই বিশ্বাস করেছিলেন। নিক্সনের পদত্যাগের এক মাস পরে ফোর্ড জাতিকে বলেছিলেন, ‘এই দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া মানুষের মনের কুৎসাকে আবারও জাগ্রত করবে। আমাদের জনগণের মধ্যে মতবিরোধ আরো তীব্র হবে। এবং আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা আবারও দেশে-বিদেশে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।’
ফোর্ডের সিদ্ধান্ত তার নিজের সন্দেহের চেয়ে অনেক বেশি বিতর্কিত হয়েছিল। নিক্সনকে এভাবে বেকসুর খালাস হতে দেখে মার্কিন জনগণ নাখোশ হয়। ফলে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং ফোর্ডকে ক্রমাগত প্লাকার্ড ও স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়। সঙ্গে কমতে থাকে তার অনুমোদনের রেটিং। দেশের জনগণের মধ্যে মতবিরোধ কমে যাবে বলে যে আশা তিনি করেছিলেন, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল দ্রুতই। ঘটেছিল উলটোটা। আসন্ন দশকগুলোতে দেশের লাল ও নীল দলের মাঝের বিভক্তিরেখাটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠেছিল। ফোর্ডের ক্ষমা ঘোষণা তার অনিচ্ছা সত্ত্বে হলেও প্রকৃতপক্ষে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার ফেডারেল সরকারের সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ করে। এর পরিণামও উল্লেখযোগ্য ছিল। ১৯৭০ সালের প্রথমার্ধে কার্যনির্বাহী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একাধিক কংগ্রেসনাল সংস্কার (যেমনÍ১৯৭৩ সালের ওয়ার পাওয়ার রেজল্যুশন এবং ১৯৭৪ সালের কংগ্রেসনাল বাজেট এবং ইমপাউন্ডমেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট) করা সত্ত্বেও, আমেরিকান রাজনীতির গতিপথ বিপরীত দিকেই চলে যায়; মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা দিনের পর দিন ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষমতাশালী হতে থাকেন।
ইরান কনট্রা স্ক্যান্ডালের সময় এই সীমাবদ্ধতা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের জাতীয় নিরাপত্তা দল ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রির তহবিল ব্যবহার করে নিকারাগুয়ায় কমিউনিস্ট-বিরোধী শক্তিকে আর্থিক সহায়তা করে। এক্ষেত্রে তারা সরাসরি মার্কিন তহবিল ব্যবহার করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ওপর কংগ্রেসের যে নিষেধাজ্ঞা, সেই ফাঁককে অপব্যবহার করে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশও আকস্মিকভাবে ৯/১১-এর পরে জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার ক্ষমতা প্রসারিত করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, গ্যারেট গ্রাফ নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি ভাষ্যে লিখেছেন, ‘ফোর্ডের রেখে যাওয়া নজির প্রায় অর্ধশতক ধরে মার্কিন প্রসিকিউটরদের পঙ্গু করে রেখেছে বলে মনে হচ্ছে। সেই নজির এবং বিচার বিভাগের নীতিসমূহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক অচলাবস্থায় নিয়ে গেছে, যেখানে রাষ্ট্রপতিরা দায়িত্ব পালনকালে বিচার থেকে মুক্ত এবং অফিস ছাড়ার পরে রাজনৈতিকভাবে অস্পৃশ্য।’ নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলা যায়, এত দিন ক্যাপিটল হিলে বর্তমান রাষ্ট্রপতিদের বিরুদ্ধে অভিশংসনের ক্ষমতা স্থাপনের জন্য ইচ্ছা প্রকাশের প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। তবে তাদের বিরুদ্ধে আইন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। অন্তত যত দিন না ট্রাম্প সেই স্থিতাবস্থা পরীক্ষা করে বসলেন। ফলে স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ এখন ফোর্ডের সেই স্মারক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি প্রত্যাখ্যান জারি করেছেন। এখন একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, সাবেক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যে কোনো প্রশাসনেরই আইনি মানদ- যথেষ্ট উচ্চ থাকতে হবে। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনি ফলাফল নস্যাতের প্রচেষ্টায় ট্রাম্পের সংশ্লিষ্টতা বিবেচনা করলে তার বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রতিক্রিয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কথিত অপরাধগুলো এতটাই মারাত্মক যে, সেগুলো মার্কিন গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে জবাবদিহি অত্যাবশ্যক।
অভিযুক্তিকরণ দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার একটি ধাপমাত্র, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা ও আইনি বাধ্যবাধকতা জারি করা। এই আইনি বাধাগুলো সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে বিগত প্রশাসনগুলো দ্বারা।
অভিযোগের প্রতি এবং পরবর্তী বিচারের ফলাফল নিয়ে ভোটাররা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, সেটি এখন একটি উন্মুক্ত প্রশ্ন। যখন ৬৯ শতাংশ রিপাবলিকান ও রিপাবলিকান-ঘেঁষা স্বতন্ত্ররা বিশ্বাস করেন যে বাইডেনের ২০২০ সালের নির্বাচনি জয় অবৈধ ছিল, তখন ট্রাম্পের সর্বশেষ এই অভিযোগগুলো অন্তত রিপাবলিকান প্রাইমারিগুলোতে তার অবস্থানে প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা নেই। বরং এই অভিযুক্তি থেকে ট্রাম্পের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এবং এতে তার নিজের ব্যাপারে তার যেই রাজনৈতিক ভাষ্য, তা আরো জোরদার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তবে ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার সিদ্ধান্তের হিসাবটা সাবেক রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া অনুচিত। বরং, দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি যে, কীভাবে আমরা বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতিদের তাদের দায়বদ্ধতার প্রতি সীমাবদ্ধ রাখতে পারি। সেই হিসাবে রাষ্ট্রপতি ফোর্ড নিক্সনকে ক্ষমা করার প্রায় ৫০ বছর পরে এসে গত সপ্তাহের সিদ্ধান্তটা মার্কিন ইতিহাসে একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ( উৎস: দৈনিক ইত্তেফাক অন লাইন) লেখক: অধ্যাপক, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়