গায়েবানা জানাজার ব্যাপারে মোটামুটি বেশ কিছু হাদিস পাওয়া গেলেও বিশুদ্ধ সনদে কেবল নাজ্জাশি বাদশাহর গায়েবানা জানাজা পড়ার ব্যাপারটিই পাওয়া যায়। যেমন- যে দিন নাজ্জাশি মারা গেলেন, সে দিনই রাসূল সা: তার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করলেন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে জানাজার মাঠে হাজির হলেন এবং তাদেরকে কাতারবন্দী করলেন। তারপর চার তাকবির দিলেন। (বুখারি-১২৪৫, ১২১৮, মুসলিম-২২৪৭, আহমাদ-২০০০৫) গায়েবানা জানাজা বৈধ না অবৈধ, জায়েজ না বিদয়াত ইত্যাদি মতানৈক্য নিয়ে যারা আলোচনা করছেন তাদের প্রত্যেকের কাছেই দলিল হলো উপরোক্ত হাদিসটি। মজার ব্যাপার হলো- ওই হাদিসটি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে গায়েবানা জানাজার ব্যাপারে আলেমসমাজ তিনটি রায়ে বিভক্ত হয়ে গেছে।
১. গায়েবানা জানাজা জায়েজ; ২. গায়েবানা জানাজা জায়েজ নেই; ৩. বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য জায়েজ।
প্রথম মত : গায়েবানা জানাজা জায়েজ মর্মে মতামত প্রদানকারী মুহাক্কিকদের কাছে যুক্তি হলো : ক. নাজ্জাশি বাদশাহর জানাজাসংক্রান্ত উল্লিøখিত হাদিস। রাসূল সা:-এর কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিই হলো উম্মতের জন্য সবচেয়ে বড় নুসুস। তা ছাড়া ওই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাযম রা: বলেন, ‘অনুপস্থিত মৃতের জানাজা পড়া যাবে। রাসূল সা: নাজ্জাশির জানাজা পড়েছিলেন। তাঁর সাথে কাতারবন্দী হয়ে সাহাবিরাও পড়েছিলেন। এটি হচ্ছে তাদের এমন ইজমা (ঐকমত্য) যা এড়িয়ে যাওয়া বৈধ নয়।’
রাসূূল নিজে পড়েছেন। সাহাবিদের পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। এ কথা উল্লেøখ করে ইবন হাযম আরো বলেন, ‘এটি হচ্ছে রাসূলের নির্দেশ, তার আমল এবং সব সাহাবির আমল। এর চেয়ে বিশুদ্ধ কোনো ইজমা হতে পারে না।’
খ. গায়েবানা জানাজার উদ্দেশ্য হলো, মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করা। যেমনটি ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে হজরত আবু হুরায়রা থেকে নাজ্জাশির জানাজাসংক্রান্ত ঘটনায় বর্ণনা করেন- ‘রাসূল সা: নাজ্জাশির মৃত্যুসংবাদ দিয়ে সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা তার জন্য ইস্তিগফার করো।’ (বুখারি, পর্ব : ২৩/৬১, হাদিস-১৩২৭, মুসলিম, ১১/২২, হাদিস-৯৫১)
এ ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি কিতাবে গায়েবানা জানাজা জায়েজের পক্ষে ফতোয়া রয়েছে। (এলাউস সুনান অষ্টম খ-, পৃষ্ঠা-২৩৪, তাবারানি, কাবির ১৯তম খ-, পৃষ্ঠা-৪২৮)
সুতরাং বুঝা যায়, দোয়া ও ইস্তিগফার লাশ সামনে থাকলে যেমন করা যায়; লাশ না থাকলেও করা যায়।
দ্বিতীয় মত : গায়েবানা জানাজা কোনো অবস্থাতেই জায়েজ নেই মর্মে একশ্রেণীর আলেমসমাজ বলে থাকে। তাদের কাছে বেশ কিছু যুক্তির সাথে অকাট্য অনেক দলিল রয়েছে। যেমন- ক. ওই জানাজা ছিল রাসূল সা:-এর খাস। যেটি পরে করার কোনো প্রমাণ নেই সেটি বিদয়াত। কেননা, মূলনীতি হলো- ‘রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবিরা যেসব ইবাদত ছেড়ে দিয়েছেন কাজটি করার যুক্তি ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, তা বর্জন করা ওয়াজিব এবং তা করা বিদয়াত।’
খ. নাজ্জাশির জানাজায় আল্লাহ অদৃশ্য শক্তিতে নাজ্জাশিকে রাসূল সা:-এর সামনে উপস্থিত করেছেন। এমনকি অনেকের মনে হয়েছিল নাজ্জাশির লাশ সেখানে উপস্থিত করা হয়েছিল। (মুসনাদে আহমাদ-২০০০৫, ইবনে হিব্বান-৩১০২, উমদাতুল কারি শরহুল বুখারি-৭/৩৩, ফাতহুল বারি-তৃতীয় খ-, পৃষ্ঠা-২৪৩)
গ. রাসূল সা:-এর সাহাবিদের কারো জানাজা গায়েবানা পড়া হয়নি, এমনকি স্বয়ং রাসূল সা:-এর জানাজাও কোনো সাহাবি বা তাবেয়ি গায়েবানা হিসেবে পড়েননি। (ফাতহুল কাদির, তৃতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৩৬৮, যাদুল মাআদ-প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৫১৯, মানহুল জালিল-প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৩১৬) ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মত হলো : গায়েবানা জানাজা জায়েজ নেই। তা দাফনের আগে হোক বা পরে। (মাবসুতে সারাখসি-দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৬৭)
এ ছাড়া হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ আলেম আল্লামা ইবনুল হুমাম রহ: বুখারির ওই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘জানাজা সহিহ হওয়ার জন্য শর্ত হলো, মৃতকে মুসলমান হতে হবে। পবিত্র হতে হবে এবং লাশ মুসলিমদের সামনে রাখতে হবে। কাজেই অনুপস্থিত লাশের ওপর গায়েবানা জানাজা জায়েজ নয়।’ (ফাতহুল কাদির-তৃতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৩৬৬)
এ ছাড়া ফাতওয়ায়ে শামিতেও একই মতামত দেয়া হয়েছে। (ফাতওয়ায়ে শামি, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-২২৬)
এমনকি, প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনুল কাইয়ুম রহ: গায়েবানা জানাজাকে রাসূল সা:-এর সুন্নাহ পরিপন্থী হিসেবে মনে করে থাকেন বলে মতামত পাওয়া যায়। (আউনুল মাবুদ, ২০তম খ-, পৃষ্ঠা-১৬০)
তা ছাড়া গায়েবানা জানাজা জায়েজ নেই মর্মে একই অর্থদানকারী হানাফি আরো বেশ কিছু কিতাবে ফতোয়া পাওয়া যায়। বিস্তারিত দেখতে পারেন : (আল মাজমু-প ম খ-, পৃষ্ঠা-২৫৩, আল মুগনি, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৩৮৬, যারকানি, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-১০, ইলাউস সুনান, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-২৩৪, ফয়দুল বারি, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৪৬৯, মুগনি মুহতাজ, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-১৬৫, কাশফুল কান্না, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-১২৬, ফয়জুল বারি, চতুর্থ খ-, পৃষ্ঠা-৪৬৭, শরহুছ ছগির, প্রথমম খ-, পৃষ্ঠা-৫৬৯)
আবার অনেকে, নাজ্জাশির জানাজাবিষয়ক হাদিসের আলোকে মনে করে থাকেন, কারো জানাজা ইতঃপূর্বে না হয়ে থাকলে বা মুশরিক রাষ্ট্রে জানাজা দেয়া অসম্ভব হলে গায়েবানা জানাজা জায়েজ।
তৃতীয় মত : বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির গায়েবানা জানাজা পড়া যাবে। সমাজ ও মানবতার জন্য যাদের অবদান আছে। যেমন- কোনো নেককার ব্যক্তি, ভালো ব্যবসায়ী, আলেম, ধর্মীয় নেতা। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল থেকে এমন একটি অভিমত উল্লেখ করেছেন ইবনে তাইমিয়া তার আল-ফাতওয়া আল-কুবরাতে। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘কোনো নেককার ব্যক্তি মারা গেলে তার গায়েবানা জানাজা পড়া যাবে।’ সমকালীন সময়ের অন্যতম ফিকহবিদ শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায ও শায়ক সাআদি এই মতটি গ্রহণ করেছেন।
সর্বাধিক গ্রহণীয় মতামতটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কয়েকটি মতামতের দিকে নজর দিতে হবে, যেমন- নাজ্জাশি বাদশাহর জানাজার হাদিসের ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা শেষে ইমাম খাতাবি রহ: বলেন, ‘তারা ধারণা করছে যে, রাসূল সা: এই কাজটির সাথে বিশেষভাবে জড়িত; অন্যরা নয়। কারণ তিনি নাজ্জাশিকে প্রত্যক্ষকারীদের মধ্যে গণ্য। যেমনটি কোনো কোনো হাদিসে রয়েছে, ‘ভূ-পৃষ্ঠের উপরিস্থিত সবকিছু তাঁর জন্য সমতল করে দেয়া হলো এবং তিনি নাজ্জাশির অবস্থান দেখতে পেয়েছিলেন।’ এটি একটি অশুদ্ধ ব্যাখ্যা। কারণ রাসূল সা: যখন কোনো একটি কাজ করেন তখন তাঁকে সে ক্ষেত্রে অনুসরণ করা ও সে কাজটি করা আমাদের জন্য অনিবার্য হয়ে যায়। আর তার সাথে কোনো কাজকে একান্তভাবে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি দলিল ছাড়া জানা যায় না। এখানে তো এমন কোনো দলিল নেই। এটি যে একটি অশুদ্ধ ব্যাখ্যা তার বিবরণ হলো- রাসূল সা: লোকদেরকে নিয়ে জানাজার মাঠে গেলেন এবং তাদেরকে কাতারবন্দী করলেন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে সালাত পড়লেন। সুতরাং বোঝা গেল, এটি শুধু তার সাথেই খাস/বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয়। (মুয়ালিমুস সুনান, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-২৭০)
এ ছাড়া ইমাম বগভি রহ: এ মর্মে বলেন, ‘যারা ধারণা করছে যে, বিষয়টি শুধু রাসূলের জন্যই খাস, তাদের এই অবস্থানটি দুর্বল। কারণ রাসূল সা:-এর সব কর্মকা-ে তাঁর ইক্তেদা/অনুসরণ করা সবার ওপর ওয়াজিব যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সাথে খাস হওয়ার দলিল না পাওয়া যায়। এখানে খাস হওয়ার দাবিটি ঠিক নয়; কারণ তিনি তো শুধু একাই গায়েবানা জানাজা পড়েননি; বরং তার সাথে লোকেরাও পড়েছে।’ (শরহুস সুন্নাহ, প ম খ-, পৃষ্ঠা-৩৪১)
উপরে ইবনে হিব্বানের হাদিস উল্লেখ করেছি। ইবনে হিব্বান কর্তৃক ইমরান বিন হুসাইনের হাদিসের জবাবে আওনুল মাবুদ গ্রন্থকার বলেন, ‘এ হাদিস দ্বারাও প্রমাণ হয় না যে, নাজ্জাশির লাশ তাঁদের সামনে ছিল; বরং এর অর্থ হলো, আমরা রাসূলের পেছনে ওইভাবে সালাত পড়েছি যেভাবে মৃতব্যক্তির ওপর সালাত পড়া হয়। অর্থাৎ জানাজার মতো করেই। আর আমাদের অবস্থাটি এমন ছিল যে, আমরা মৃতকে দেখছি না। তবুও এমনভাবে কাতারবন্দী হলাম ঠিক যেভাবে উপস্থিত লাশের সামনে কাতারবন্দী হতে হয়। যেন মৃত ব্যক্তি আমাদের সামনেই রয়েছে। রাসূল সা: যেন উপস্থিত দৃশ্যমান ব্যক্তির জানাজাই পড়ছেন। ইমাম তবারানি কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বিষয়টি সুস্পষ্ট করেই বলা হয়েছে : ‘আমরা রাসূলের পেছনে দুই কাতারে দাঁড়ালাম। আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।’ (আওনুল মাবুদ, নবম খ-, পৃষ্ঠা : ৯-১০)
সর্বশেষ, যেহেতু রাসূল সা: থেকে সরাসরি নাজ্জাশির গায়েবানা জানাজা পড়ার নুসুস রয়েছে বিশুদ্ধ সনদে এবং তা পরবর্তী সময়ে নিষেধ করা হয়নি সেহেতু বৈধতার পক্ষে এটি একটি দলিল। কেননা রাসূল সা:-এর কথা, কাজ এবং মৌন সম্মতিই হলো শরিয়াহর জন্য নস। এ ছাড়া বিপরীত মতকেও আমাদের প্রাধান্য দেয়া উচিত যেহেতু প্রত্যেক মতামতই পরস্পর দলিলের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয়েছে। লেখক : সরকারি চাকরিজীবী (শিক্ষক), লেখক ও গবেষক