নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল রোমার, শুল্ক পরিবর্তনের ফলে সম্পদের ওপর প্রভাব প্রসঙ্গে ‘ট্রিকল-ডাউন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ‘ট্রিকল-ডাউন’ অর্থনীতির একটি কৌশল এবং যাকে বলা হয় চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্ব; অর্থাৎ সম্পদশালীদের সম্পদের যেটুকু চুঁইয়ে পড়বে তা সম্পদহীনরা পাবে। তবে অর্থনীতিবিদ টমাস সোওয়েলের মতে ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতি কোনো অর্থনীতিবিদ সমর্থন করেননি। তার মতে, “কেন কেউ সমর্থন করবে যে আমরা একজনকে সুযোগ করে দেবো এই আশায় যে, তার সম্পদের অংশ অন্যদের কাছে চুঁইয়ে চলে আসবে? ‘ট্রিকল ডাউন’ তত্ত্ব দিয়ে নিচের তলার মানুষের উন্নতি সম্ভব নয়। জন কেনেথ গ্যালব্রেথ উল্লেøখ করেছেন, ‘ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতি’-এর আগে ১৮৯০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ঘোড়া-ও-চড়ুই তত্ত্ব’ নামে চেষ্টা করা হয়েছিল। তার মতে, ‘যদি আপনি ঘোড়াকে পর্যাপ্ত ‘ওটস’ খাওয়ান, তবে তার কিছুটা চড়ুইদের জন্য রাস্তায় পড়ে থাকবে।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত দেশগুলো অনেক তত্ত্ব বাস্তবায়নের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য দূর করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। অধিকাংশ তত্ত্ববিদের মতে, শিল্পায়নের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষিভিত্তিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে এবং দেশের আয় (জিডিপি এবং জিএনআই) বাড়বে। তারা ধরেই নেন যে, তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের আয় বাড়লে ওই দেশের দারিদ্র্য এবং আয়বৈষম্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কমে যাবে। কারণ সমাজের সম্পদশালীদের কর হ্রাস, ভর্তুকি প্রদান, আয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগ থেকে উচ্চ হারে মুনাফা অর্জন ইত্যাদি সুবিধা এবং বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিলে অর্জিত লভ্যাংশ তার সম্পত্তিতে আরো বেশি বিনিয়োগ করবে, ফলে দেশে বেকারদের কর্মসংস্থান হবে; আয় বাড়াবে। আর যদি সরকার কর বাড়িয়ে তাদের আয় কেড়ে নেয় তাহলে সম্পদশালীরা বিনিয়োগ করতে পারবে না, ফলে গরিব উপকৃত হতে পারবে না।
অর্থনীতিবিদ আর্থার লেফার বলেন, সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে কর কমালে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। অন্যদিকে, সরকার কর বাড়ালে রাজস্ব আয় নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং ওই পরিমাণের পর থেকে পুনরায় কর বাড়ালে তা সরকারের রাজস্ব আয় কমিয়ে দেয়। তার মতে, মানুষ যখন দেখবে তার আয়ের বড় অংশ কর পরিশোধে চলে যাচ্ছে তখন সে কাজ করতে অনুৎসাহিত হবে এবং বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগ করার বদলে যেখানে করের পরিমাণ কম সেখানে বিনিয়োগ করতে, অর্থাৎ অর্থ পাচারে উৎসাহী হবে।
নোবেলবিজয়ী জোসেফ স্টিগলিটজ ২০১৫ সালে লিখেছিলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রমাণগুলো ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতিকে সমর্থন করে না; বরং ‘ট্রিকল-আপ ইকোনমিক্স’কে সমর্থন করে, যার ফলে দরিদ্র বা মধ্যবিত্তের পকেটে বেশি অর্থ থাকায় সবাই উপকৃত হয়। অর্থনীতিবিদ ডেভিড হোপ ২০২০ সালের গবেষণায় দেখেছেন, ধনীদের জন্য ট্যাক্স কাটছাঁট ধনীদের ধনী করতে সফল হয়েছে, মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি বা কর্মসংস্থানের ওপর কোনো উপকারী প্রভাব নেই। আইএমএফ ২০১৫ সালে তার কর্মীদের সাথে স্টাফ আলোচনায় বলেন, ‘শীর্ষ ২০ শতাংশ ট্যাক্সধারীর ট্যাক্স কমালে তাতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস হতে পারে।’ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সঠিক নীতি করা হলে অসমতা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, আবার ভুল নীতির কারণে অসমতা লাগামছাড়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা রোনাল্ড রিগ্যান ও মার্গারেট থ্যাচারের নব্য উদারবাদী নীতির সমালোচনা করেন। এই নীতির ফলে ভারত ও চীনের প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে অসম দেশের একটি। সে জন্য যথাযথ নীতি প্রণয়নে গুরুত্ব দেন তারা।
অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি দেখিয়েছেন, গত শতকের শুরুতে ইউরোপে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের হাতে ছিল মোট সম্পত্তির প্রায় ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালে অনুপাতটা দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। ইউরোপে তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি ১০ শতাংশ ধনীর হাতে ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পদ, এখন সেটি ৭০ শতাংশ। সে জন্য তিনি ধনীদের ওপর অনুক্রমিক করারোপের পক্ষপাতী।
ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতির প্রয়োগ: আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানসহ অনেক প্রভাবশালী রিপাবলিকান নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল রোমারের ‘ট্রিকল-ডাউন’ তত্ত্ব সমর্থন করেন। অর্থনীতিবিদ রাকিব হোসাইনের মতে, প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ১৯৮০-এর দশকে লেফারের এই তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধনীদের ওপর যে আয়কর প্রায় ৭০ শতাংশ ছিল, তা প্রায় ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রিগ্যানের এই নীতির ফলে আমেরিকা তৎকালীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব থেকে অনেকটাই সুরক্ষা পেয়েছিল। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৯-২০০৫ এর মধ্যে আমেরিকার সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ জনগণের আয় বেড়েছে ৬ শতাংশ এবং সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় বৃদ্ধি পায় ৮০ শতাংশ। এই আয় বৃদ্ধির ফলে ৫ শতাংশ ধনীর হাতে আমেরিকার ৬৩ শতাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয় আর বাকি ৯৫ শতাংশ জনগণের হাতে থাকে বাকি ৩৭ শতাংশ সম্পদ।
বাংলাদেশ এই তত্ত্বে কতটা বিশ্বাসী তা বোঝার জন্য কিছু বিষয় জানা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমানে করপোরেট কর ২৫ শতাংশ, যা ২০০৯ তে ছিল ২৭ শতাংশ। কিন্তু কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাংলাদেশে যথেষ্ট থাকলেও তার শাস্তি প্রায় নেই বললেই চলে। এটি সম্পদশালীদের এক ধরনের সুবিধা দেয়া নয় কি? সূত্রমতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদের পরিমাণ মোট জাতীয় সম্পদের ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে তা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে, শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর আয় জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের আয়ের অনুপাত ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। অন্য হিসাব মতে, বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের হাতে দেশের ২৮ শতাংশ সম্পদ এসে জমা হয় আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ জনগণের হাতে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ। নিউ ইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে অতি ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। যা আমাদের দেশের ধনী দরিদ্রের মধ্যকার অর্থনৈতিক অসমতা নির্দেশ করে। এর পেছনে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ কর হার বেশি হওয়া অনেকাংশে দায়ী। কর দিতে সক্ষম বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনো কর দেয় না। এদের করের আওতায় আনা হলে দেশের উন্নয়ন অনেকাংশে বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক অসমতাও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এদিকে ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের জিডিপির আকার বেড়েছে প্রায় সাড়ে সাতগুণ। শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর সম্পদ ও আয়ের অনুপাত কিছুটা কমলেও জিডিপির বহর যে হারে বেড়েছে, তাতে এই শ্রেণীর মানুষের সাথে বাকিদের বাস্তব ব্যবধান অনেক বেড়েছে। এই ২০ বছরে দেশে মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তবে বৈষম্য বেড়েছে মারাত্মকভাবে।
ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতি বিষয়ে জো বাইডেন: প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক টুইটে বলেছেন, ‘আমি এসেছি মধ্যবিত্তকে শক্তিশালী করতে এবং এ দেশের ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটাতে।’ একে বলা হচ্ছে বাইডেনোমিক্স। বাইডেন তার পূর্বসূরি ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টদের মতো ধনীদের কর রেয়াতের রাশ টেনে সে অর্থ অসচ্ছলদের স্বাস্থ্যসেবাসহ সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যবহার করছেন।
অন্যদিকে ট্রিকল-ডাউনে বিশ্বাসী ট্রাম্পসহ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের বিশ্বাস ও কর্ম হলো ধনীদের কর ছাড় দেয়া হলে তারা আয় করা বাড়তি অর্থ তাদের উদ্যোগ সম্প্রসারণে ব্যবহার করবে আর ধনীদের মোটাতাজা হওয়ার সুবিধা কর্মসংস্থান আকারে চুঁইয়ে গরিব মধ্যবিত্তদের কাছে যাবে। বাস্তবে ট্রিকল ডাউনে যুক্তরাষ্ট্রে ধনীদের কাছে সম্পদ অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এই কেন্দ্রীভূতকরণ ঠেকাতে প্রফেসর ইউনূস সামাজিক ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করে নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদে মানবিক ভারসাম্য আনতে চাইছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বনাম ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতি: বর্তমান সরকারি দলটি স্বাধীনতা-উত্তর মেয়াদে ট্রিকল ডাউন অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিল না; বরং এই দলটির এবং দেশটির স্বাধীনতার অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল সমাজতন্ত্র। তবে চলতি মেয়াদে, বর্তমান সরকার তাদের সেই সময়কার নীতি থেকে দেশকে বের করে এনে ট্রাম্পীয় নীতি থেকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী অলিগার্করা করের নেট থেকে বিভিন্নভাবে বাইরে থাকার সুযোগই শুধু পাচ্ছেন না, সে সাথে শেয়ার বাজার কারসাজি করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পুঁজি ও ব্যাংকের তহবিল হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ব্যাংকের দেশী-বিদেশী মুদ্রার তহবিলে অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা কঠিন করে ফেলেছে। দেশের অর্থনীতির বড় অংশ এখন গুটিকয়েক পরিবারের হাতে জিম্মি, যারা দেশের ব্যবসায়, রাজনীতি, আইন, বিচারব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম, সমাজ, ব্যাংক, পুঁজিবাজার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে টাকার জোরে, ক্ষমতার জোরে। অর্থনীতিতে এই ধারা চললে বাংলাদেশ হয়ে পড়তে পারে ‘রাজনৈতিক অলিগার্কদের জন্য, অলিগার্কদের দ্বারা, অলিগার্কদের রাষ্ট্র।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি চলে যাচ্ছে ছোট একটি গোষ্ঠীর শাসনে যারা খুবই ধনাঢ্য, দোর্দ- প্রতাপশালী এবং ক্ষমতাসীনদের সাথে ঘনিষ্ঠ। এ ব্যাপারে এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট ইমেইল: mizan12bd@yahoo.com