সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৫ অপরাহ্ন

ঢাকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

গুরুত্ব পাবে অস্ত্র, স্যাটেলাইট ও বিমান ক্রয়
ভারতে জি-২০ সম্মেলন শেষে দুই দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। গতকাল রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। এসময় ম্যাক্রোঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। গত ৩৩ বছরের মধ্যে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টের এটি প্রথম ঢাকা সফর। জানা গেছে, ম্যাক্রোঁর এ সফরে ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে দুটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই হবে।
ঢাকায় পৌঁছানোর পর প্রধানমন্ত্রীর আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। আজ সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। এরপর দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই শেষে উভয় নেতা একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে তার সঙ্গে থাকছেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী কেথেরিন কলোন্না। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সরকারের আশা, ম্যাক্রোঁর এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হবে ও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সফর করেন। ১৯৯০ সালের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিত্রান্দের বাংলাদেশ সফরের পর ম্যাক্রোঁই প্রথম নেতা যিনি বাংলাদেশ সফর করছেন। মিত্রান্দের ওই সফরের পর থেকে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে মোট বাণিজ্য ২১০ মিলিয়ন ইউরো থেকে ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে ও ফ্রান্স রপ্তানির ক্ষেত্রে পঞ্চম দেশ। ফরাসি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশের প্রকৌশল, জ্বালানি, মহাকাশ ও পানিসহ বিভিন্ন খাতের সঙ্গে জড়িত। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দ্বিপাক্ষিক সফরে গতকাল রোববার ঢাকায় এসেছেন। সফরকালে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় স্যাটেলাইট বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। এর বাইরে অস্ত্র, উড়োজাহাজ ক্রয় এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। বিবিসি এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে। ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের এই সফরে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলেছে, এই সফর দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাবে।
যেসব বিষয় গুরুত্ব পাবে: কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই সফর কয়েকটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্স বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে অনেক দিন ধরে। দেশটি মিলিটারি হার্ডওয়্যার শিল্পেও বেশ প্রভাবশালী। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িংয়ের আধিপত্য কমাতে বাংলাদেশে বিমান বহরের জন্য এয়ারবাস কোম্পানির উড়োজাহাজ কেনার কথা বিবেচনা করছে বাংলাদেশ সরকার। অন্যদিকে, ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ফ্রান্সের আলাদা কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে এবং এ অঞ্চলে দেশটির সামরিক উপস্থিতিও আছে। দেশটি এখন চাইছে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, ফরাসিরা ব্যবসা ও ভূ-কৌশলগত বিষয়ে সবসময় বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট নিজেই যেহেতু আসছেন তাই সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে আলোচনা হবেই। আমার ধারণা সেটি ব্যবসায়িক বিষয়ই হবে। ব্যবসার জন্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সরাসরি ভূমিকা রেখে থাকেন। আর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার মো. আব্দুল হান্নান বলছেন, ফ্রান্স ইউরোপের প্রভাবশালী একটি দেশ এবং ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক বিবেচনায় ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ফ্রান্সের গুরুত্ব দেওয়ার প্রমাণই হলো দেশটির প্রেসিডেন্টের সফর।
আশা করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের বড় ২২টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই ফ্রান্স প্রযুক্তি ও ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ কারণে শীর্ষ পর্যায়ের এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আরও জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে এ সফরে। এটি হবে একটি আর্থ অবজারভেটরি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থলভাগ ও জলভাগ পর্যবেক্ষণ সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে। এটিও নির্মাণ করেছিলো ফরাসি একটি প্রযুক্তি কোম্পানি। এ ছাড়া এয়ারবাস কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কেনার বিষয়ে উভয় দেশের কর্মকর্তারা আলোচনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর থেকে দেশটির সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেই চলতি বছরের শুরুতে ফ্রান্সের এয়ারবাস কোম্পানি থেকে দশটি উড়োজাহাজ কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং থেকেও নতুন উড়োজাহাজ কেনা অব্যাহত রাখার বিষয়েও চাপ আছে। এমন পরিস্থিতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ সফরে বিষয়টি আলোচনায় আসবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০২১ সালে শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময়ে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলো বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। দেশটি অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশও ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেছে। এসব নিয়ে আলোচনার জন্য ২০২১ সালে শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের আগে ২০২০ সালের মার্চে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ঢাকায় এসেছিলেন। যার মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের কাছে রাফাল জঙ্গি বিমান বিক্রির প্রস্তাব তুলে ধরা।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, সমরাস্ত্র হোক আর এয়ারবাস হোক- তাদের মূল ফোকাসই থাকবে ব্যবসা। আর মনে রাখতে হবে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের স্বতন্ত্র সামরিক উপস্থিতি আছে। অর্থাৎ এ অঞ্চলটি তাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই ফ্রান্স চাইবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে। সাগরে আমেরিকা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়া। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উপস্থিতি আছে ফ্রান্সেরও। স্বস্তি আসবে সরকারের জন্য? কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছেন, জি-২০ সামিট থেকে ঢাকায় আসার যে সিদ্ধান্ত ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিয়েছেন তার রাজনৈতিক গুরুত্বও আছে। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র যখন নানা ইস্যুতে ক্রমাগত চাপ তৈরি করছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকস’র বিষয়েও আগ্রহ রয়েছে ফ্রান্সের।
অন্যদিকে, পশ্চিমা সরকার প্রধানদের মধ্যে একমাত্র ফরাসি প্রেসিডেন্টই চীন সফর করেছেন। চীন আবার বাংলাদেশের নানা প্রকল্পে ব্যাপকভাবে জড়িত। এমন পরিস্থিতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঢাকার সফর নির্বাচনের আগে বাংলাদেশর বর্তমান সরকারের আন্তর্জাতিক পরিম-লে ‘যুক্তরাষ্ট্রের কারণে তৈরি হওয়া অস্বস্তি’ কাটাতেও সহায়তা করবে বলে আশা করছে সরকারি সূত্রগুলো। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার আব্দুল হান্নান বলেন, ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার গুরুত্ব তৈরি করতে পেরেছে বলেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট এ সফরে আসছেন। স্যাটেলাইট ও এয়ারবাস নিয়ে উভয় দেশ কাজ করছে। এখন এসব নিয়ে চুক্তি করা বা চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হওয়া মানে হলো ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির অংশীদারিত্বের জন্য বাংলাদেশকে সক্ষম বলে বিবেচনা করছে ফ্রান্স, যার রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের সফরের আগে উভয় দেশের কর্মকর্তারা কয়েক ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা দু দেশের সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পঞ্চাশ বছরও পূর্তি হয়েছে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাবেন। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক ছাড়াও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এ ছাড়া, ফরাসি প্রেসিডেন্টের সম্মানে প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত একটি ভোজসভায় ম্যাক্রোঁর যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। সফর শেষে বিমানবন্দরে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস জানিয়েছে, ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্বিপাক্ষিক সফরে ঢাকায় আসছেন। সে সময়ের ২১০ মিলিয়ন ইউরোর বাণিজ্য এখন ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছে। বিভিন্ন ফরাসি কোম্পানি এখন বাংলাদেশে প্রকৌশল, জ্বালানি, এরোস্পেস ও পানি খাতে কাজ করছে। এর আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সফর করেন। এখন শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ম্যাক্রোঁ ফিরতি সফরে ঢাকায় আসছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com