সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৮ পূর্বাহ্ন

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ :সমাজ সংস্কারক ‘লালসালু’ প্রেক্ষিত

আবুল কাসেম হায়দার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

“আধুনিক বাঙালি মুসলমানের বাংলা সাহিত্য চর্চায় অংশ গ্রহণ সাধারণ ভাবে কম, উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে আরো কম। ফলে প্রথম যুগের বাংলা উপন্যাস বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রতিফলন নেই বললেই চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেস দিকে মীর মোশাররফ হোসেন একাত্র গদ্য লেখক যিনি উপন্যাস রচনা করেছেন। তারপরে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিকে মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল, নজিবর রহমান প্রমুখ লেখকের আবির্ভাব হয়। এদের প্রয়াসে নীতি শিক্ষামূলক কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক বাস্তবতা কিংবা চরিত্রের অন্তর্লোকের প্রবেশের দিকে ততো মনোযোগী এঁরা হতে পারেনি। অধিকতর সকল উপন্যাস আমরা পাই কাজী আবদুল ওদুদ, হুমায়ুন কবীর, আবুল ফজল প্রমুখের রচনায়। সাহিত্য ক্ষেত্রে এঁদের উত্তরসুর শওকত ওসমান, আবু রুশদ এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। এঁরা আধুনিক চিন্তা ও মননের মানুষ সেই কারণে এঁদেরই রচনায় আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যসমূহ যথার্থভাবে উপস্থাপিত হতে দেখা যায। সমাজকে ব্যক্তিকে এবং সেই সঙ্গে সামগ্রিক জীবনকে বিশ্লেষণ করে এঁরা উপন্যাসের শিল্পরূপের মধ্যে তা ধারণ করেছেন। বলা যায়, এই প্রজন্মের মুসলমান লেখকরাই পরিণত উপন্যাস শিল্পী হয়ে উঠতে পেরেছেন।”
কথা সাহিত্যিক শওকত আলী তাঁর এক নিবন্ধে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। সেই মানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একজন আদর্শিক উপন্যাসিক, কথাশিল্পী, সৃজনশীল সুলেখক।
১৯২২ সালে ১৫ই আগস্ট সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলায়। পিতা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মাতার নাম ছিল নাছিম আরা খাতুন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। চট্টগ্রাম জেলার ষোলশহরে তাঁদের বাস ছিল।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাবা ছিলেন ব্রিটিশ রাজ্যের সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তাই কিশোর সময় বাবা মায়ের সঙ্গে ময়মনসিংহ, ফেনী, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি জেলায় কাটান। তিনি ১৯৩৯ সালে কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ‘মেট্রিকুলেশন’ পাস করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে আইএ এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী পরবর্তী তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিষয়ে পড়ার জন্য এমএ ভর্তি হন। কিন্তু তিনি এমএ পড়া শেষ করতে পারেননি। এমএ পাস করার পূর্বেই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি কলিকাতা বিখ্যাত ইংরেজী দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতায় চাকরি শুরু করেন। এবং ধীরে ধীরে কলিকাতা সাহিত্যমহলে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। তিনি স্কুল জীবন থেকে লেখালেখি করে এসেছেন। প্রবন্ধ, ফিচার লেখা তার বিজয়ে পরিণত হয়। কলিকাতা গিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি কলিকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি করাচি বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫১ সাল থেকে বিদেশে বৈদেশিক মন্ত্রণালয় অধীনে ঢাকা, সিডনী, করাচি, জাকার্তা, বন, ল-ন এবং প্যারিসে সরকারি চাকরি করেন। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল প্যারিস।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন লেখনির মাধ্যমে এবং জনমত গঠনের মাধ্যমে। তাই সরকারি চাকরি তিনি ছেড়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে তিনি ১৯৭১ সালের ১০ই অক্টোবর প্যারিসে পরলোকগমন করেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ আসন দখল করে আছেন। তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা কম হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলিষ্ঠ, গঠনমূলক, রুচিশীল, সমাজ সংস্কারমূলক। বিশেষত তাঁর গল্প, উপন্যাস ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বহির্লোকে এবং অন্তলোকের যে সুষ্ম ও গভীর রহস্য উদঘাটন করেছেন তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে খুবই কম। কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মবিশ্বাসে আচ্ছন্ন, বিপর্যস্ত, আশাহীন ও মৃতপায় সমাজ জীবনের চিত্র যেমন এঁকেছেন একদিকে, তেমনি অন্যদিকে মানুষের মনের ভেতরকার লোভ, প্রতারণা, ভীতি ঈর্ষা প্রভৃতি প্রবৃত্তিগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিজ্ঞানীর মতোই উদঘাটিত করেছেন তিনি। সাদা মাটা গল্প, উপন্যাস রচনা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ কলমে আসেনি। তিনি মানব জীবনের মৌলিক সমস্যা সমূহকে পাঠকের সামনে অতি যতœ সহকারে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
স্কুল জীবন থেকে তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ছাত্রজীবনে থেকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৬ সারে তার প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘নয়নতারা’ কলিকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘দুইতীর’ ১৯৬৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালু’ রচনা করেন ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা ১৯৬৪ সালে এবং তৃতীয় উপন্যাস ‘কাদো নদী কাঁদো’ ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। তিনি উপন্যাসও ছোট গল্পের সঙ্গে সঙ্গে নাটকে ও গুণী ছিলেন। ‘বহিপীর (১৯৫৫) তরঙ্গ তঙ্গ (১৯৬৪), ‘সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) তিনটি বিখ্যাত নাটক প্রকাশিত ও মঞ্চস্থ হয়।
ছোট গল্প লেখক হিসাবে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বেশ পাকা ছিল। তাঁর বিখ্যাত ছোট গল্প এই নয়ন তারা (১৯৪৫), বৃটিশ ভারত আমলে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে দ্বিতীয় গল্প এই দুই তীর ও অন্যান্য গল্প ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যে তাঁর ‘লাল সালু’ উপন্যাসটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সারা জীবন বিদেশে, উন্নত দেশে বসবাস ও জীবন কাটানোর পরও তিনি গ্রামীণ মানুষের জীবন, কর্ম ও নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে ‘লালসালু’ উপন্যাস লিখেন। এই উপন্যাসটি তাঁর ফরাসী স্ত্রী অহহব সধৎরপ ইংরেজীতে ও ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করেন।
১৯৫৫ সালে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ অস্ট্রেলিয়া সরকারি চাকরি করা কালীন সিডনীতে ফ্রান্সের এই মহিলা অহহব গধৎরব কে বিবাহ করেন। তাদের ঝরসরহব এবং ওৎধল নামে দুই সন্তান।
২০০১ সালে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ লেখা লাল সালু উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপদান করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারক তানভীর মোকাম্মেল। সুধীমহলে, সাধারণ মহলে লালসালু সিনেমা চমৎকার আলোড়ন সৃষ্টি করে। এইসব সাহিত্যকর্মের জন্য সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ স্বদেশের মানুষের নিকট যেমন সম্মানিত ছিলেন, তেমনি বিদেশী সাহিত্য অঙ্গনে তিনি ছিলেন আলোচনার বস্তু। বিশেষ করে লালসালু তাকে ইংরেজী ও ফরাসি সাহিত্যানুরাগীদের নিকট সুপরিচিত করে তুলেছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। আধুনিক ও নাগরিক রুচি ও মননের অধিকারী লেখক অনেক সময় কলিকাতা ইংরেজী দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন, তখন বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার জীবন নানা ঘাত প্রতিঘাতে অস্থির ও চঞ্চল। স্বাধীনতা ও পাকিস্তান আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা আবার একই সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রগঠনের উদ্দীপনা সব মিলিয়ে মধ্যবিত্তের জীবনে এক দুরন্ত ক্রান্তিকাল চলেছিল।
ঐ সময় একজন নবীন লেখকের পক্ষে তাঁর চারিদিকের পরিচিত জীবন ও মানুষ নিয়ে গল্প, উপন্যাস লেখা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি সেই পথে গেলেন না। তিনি পদাপণ করলে ভিন্ন এক মাত্রা। তিনি ‘লালসালু’ মত উপন্যাসের পটভূমি ও মানুষের সমাজ বেচে নিয়ে গ্রাম বাংলার প্রকৃত চিত্র উপন্যাসে চিত্রায়িত করলেন।
গ্রাম প্রধান আমাদের বৃহত্তর দেশ ও সমাজ। বেশির ভাগ মানুষই গ্রামে থাকে সেখানেই তাদের বাঁচা মরা এবং জীবনযাপন। সেই সমাজে এমন এক রীতি নীতি ও ধারণা বিশ্বাস জন্ম লাভ করে লালিত হয়ে চালু থাকে যা শহরবাসী শিক্ষিত লোকের অভিজ্ঞতার বাইরে। অথচ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর প্রথম উপন্যাসের পটভুমি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং তার সমাজ-চরিত্র, এক দিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু শোষিত দরিদ্র গ্রামবাসী, অন্যদিকে শঠ, প্রতারক, ধর্ম ব্যবসায়ী এবং শোষক ও ভূ-স্বামী। আর তার উপন্যাসের বিষয় যুগ যুগ ব্যাপী শিকড় গড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনকাক্সক্ষার দ্বন্দ্ব।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ একজন মানবতাবাদী লেখক। মানুষের যুক্তি এবং বিকাশ এই ইচ্ছা যে তাঁর সাহিত্য রচনার মুল বিষয় ছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই। আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতায় বা মানুষের বিকাশের পথে অন্তরায় সেও লোকে তিনি চিহ্নিত করেছেন, দেখিয়েছেন কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের এক প্রচন্ড দাপট। সরল ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে কিভাবে বিভ্রান্ত ভীত করে শোষণের প্রক্রিয়া চালু রাখা হয় তারই বর্ণনা তিনি তার উপন্যাসে দিয়েছেন।
আমাদের চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলায় জন্ম নেয়া আর এক কৃতি সন্তান, বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক, মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ (১৯০৭-১৯৭৮), যিনি নিজ জন্মভুমি লোকের কাছে এবং বন্ধু বান্ধব মহলে এক কালে ‘ওয়ালি গান্ধী’ নামে পরিচিত ছিলেন। আজকের প্রবন্ধে তিনি হচ্ছেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। তিনিও চট্টগ্রাম জেলার ষোলশহরে জন্ম নিয়ে বাংলা সাহিত্য জগতে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
‘ওয়ালি গান্ধী’ যেমন আমাদের মুক্তি সংগ্রাম (১৯৫৩), যুগম বিচিত্রা (১৯৬৭), সেকালের কাহিনী (১৯৫০), প্রভৃতি গ্রন্থ লিখে অমর হয়ে আছেন। ওয়ালি গান্ধী ১৯৬৭ সালে যুগ বিচিত্রা গ্রন্থ লিখে দাউদ পুরস্কারও লাভ করেন।
তাই অনেক সময় দুই লেখকের একই ধরনের নাম হওয়ার কারণে আমরা পাঠক অনেক সময় পরিচয় সমস্যায় পড়ে যাই। কিন্তু সাহিত্যকর্মে দু’জনই আমাদের অতি প্রিয়।
বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সমাদৃত হয়েছেন। তিনি তার সাহিত্যকর্মের জন্য ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত হন। ১৯৬৪ সালে তার সৃজনশীল লেখনীর জন্য বিখ্যাত আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ একুশে পদক লাভের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য কর্মের স্বীকৃত অর্জন করেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাল সালু’ চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কারে ভুষিত করা হয় ২০০১ সালে।
‘লাল সালু’ উপন্যাসটি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করা হয়, যার নাম ছিল ঞৎবব রিঃযড়ঁঃ জড়ড়ষং.”
যার অবিস্মরণীয় লেখা ‘লালসালু’ লিখে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সর্বমহলে সুপরিচিতি লাভ করেন। আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যসূচীতে ‘লালসালু’ স্থান করে নিয়ে তাঁকে গণমানুষের উপন্যাসিক তথা সাহিত্যিকের হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার অপার সুযোগ করে দিয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট কথা সাহিত্যক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শওকত আলী বলেন,
‘লাল সালু’ সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহর প্রথম উপন্যাস, যে একটি দুঃসাহসী প্রয়াস। জীবন বাস্তবতা যেমন তেমনি সামাজিক বাস্তবতা ও এর ভিত্তি। গ্রামীণ জনজীবনকে এবং তার মানসিক, চিন্তা ভাবনা, সুখ দুঃখ ও বিশ্বাস সংস্কারগুলোকে উপাদান হিসাবে ব্যবহার করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং উপন্যাসের শিল্প রূপটি যাতে সুসামঞ্জস্য হয় সেদিকে লেখক দৃষ্টি রেখেছিলেন। এর ভাষা সহজ কিন্তু ব্যঞ্চনাময়। আঞ্চলিক শব্দ নিরাক বতোর, মগরা ইত্যাদি যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি পাশাপাশি ও কাছাকাছি তৎসম, অর্ধতৎসম, আধুনিক শব্দ সুন্দর ও মানানসইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতীক ও উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও লেখকের মাত্রাবোধ লক্ষ্য করার মতো। কোন প্রকার নাগরিক প্রসঙ্গ সবই তুলে এনেছেন তিনি গ্রামীণ পটভূমি থেকে। উপন্যাসের যে কাহিনী গত কাঠামো, সেটিও লক্ষ্য করার মতো। তাহেরের বাপের বিচার, আওয়ালপুরের পীর সাহেবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আক্কাস আলীর স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা এসব ঘটনা বাহিরের, সামাজিক এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতার ফাঁক পূরণ করা হয়েছে মজিদের পারিবারিক ঘটা ও চিন্তা ভাবনার কথা সাজিয়ে। ঘটনাবলী বাহিরের দিক থেকে সম্পর্কবিহীন থাকা সত্ত্বেও ‘লালসালু’ যে একটি সুসংহত শিল্পরূপ তার কারণ লেখকের শিল্পী মনের সজাগ অভিনিবেশ। একজন লেখকের প্রথম উপন্যাসে এ ধরনের শিল্প ও আঙ্গিকগত রাঁধুনি বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এই কারণেই ‘লালসালু’ উপন্যাসখানি, লেখকের প্রথম রচনা হলেও বাংলা সাহিত্যের বিশাল ও বিস্তৃত ভুমিতে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com