ফসল উৎপাদনের সাথে সেচ ও সার অত্যন্ত জরুরি। এ দুটি ছাড়া কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদন করা অসম্ভব। ফলে প্রতিটা ফসল মৌসুমে কৃষকদের এ দুটি উপকরণ নিশ্চিত করতে হয়। ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়া কিংবা বিদ্যুতের অভাবে সেচ কাজ করতে না পারায় ফসল উৎপাদন বিলম্ব হয়েছে। আমরা এটাও দেখেছি, সার না পাওয়ার কারণে কৃষকদের আন্দোলন করতে। তাদের এই আকাক্সক্ষা ও আন্দোলন যৌক্তিক। সরকারও চেষ্টা করে সময়মতো কৃষকদের সার ও সেচের ব্যবস্থা করতে। তবে মাঝে মাঝে এর ব্যত্যয় ঘটলেই সমস্যা দেখা দেয়। সার ও সেচের যেহেতু বিকল্প নেই, তাই কৃষিমন্ত্রণালয় ও কৃষি অধিদফতরকে সময়মতো এ দুটো উপকরণ কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। মাঝে মাঝে মধ্যসত্ত্বভোগীদের কারসাজিতে সারের সংকট ও উচ্চমূল্য হতে দেখা যায়। এতে বিপাকে পড়ে কৃষক। এ শঙ্কা এখন দেখা যাচ্ছে। সার সংকটের আশঙ্কা সামনে রেখে তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। সারের মজুদ ও আগামীর চাহিদার সাথে ব্যাপক ফারাক রয়েছে। সার উৎপাদন ও আমদানি যথাসময়ে করতে না পারলে সংকট যে তীব্র হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই। এ বিষয়টি সরকারকে এখন থেকেই মাথায় রাখতে হবে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা জলবায়ু পরিবতর্নজনিত কারণে অনেক আগেই আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। ইতোমধ্যে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ এ আশঙ্কা মাথায় রেখে খাদ্যশস্য রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। নিজ দেশের চাহিদা ও সংকট সামাল দেয়ার জন্য তারা আগাম প্রস্তুতি হিসেবে এ পদক্ষেপ নিয়েছে। রফতানি করলেও তা উচ্চশুল্কে সীমিত পরিসরে করছে। আমাদেরকে এ বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে বসে থাকলে হবে না। আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় যে কৃষিজমি রয়েছে, তা অপ্রতুল। কৃষকরা কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ফসল ফলাচ্ছে। তারপরও আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এ আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে দেশে খাদ্য সংকট তীব্র হয়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে।
কৃষিখাতে সার সংকট দূর করতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এই সংকট তীব্র হয়ে উঠলে কিংবা কৃষক সময় মতো সার না পেলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষিবিদরা। এখন আমনের ভর মৌসুম চলছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবার আমন চাষে প্রায় দুই সপ্তাহ বিলম্ব হয়েছে। ফলে উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য ইউরিয়া সারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আমনের পাশাপাশি আগামী অক্টোবর থেকে শীত মৌসুমের সবজি ও রবিশস্য চাষ শুরু হবে। এই সময় সারের চাহিদা থাকে বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৫ লাখ টন সার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে দেশে মজুদ আছে ৭ লাখ টন। এ মজুদ কৃষির জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, অক্টোবর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সারের প্রয়োজন হবে ১৬ লাখ টন। জানুয়ারিতে শুরু হবে ধানের সবচেয়ে বড় বোরো মৌসুম। এ সময় সারের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। আশঙ্কিত সার সংকটের দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত গ্যাসের অভাবে তিনটি সার কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ডলার সংকটের কারণে সার আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিবিদরা আশঙ্কা করছেন, যথাসময়ে সার সরবরাহ করতে না পারলে কৃষকদের খরচ যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবে, দেশে বছরে ২০ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া, ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি এবং ১৬ লাখ মেট্রিক টন ডিএপি সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি ইউরিয়া সার কারখানায় উৎপাদিত হয় মাত্র ১০ লাখ মেট্রিক টন। টিএসপি উৎপাদিত হয় ১ লাখ টন। এখন গ্যাস সংকটের কারণে তিনটি কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সার বেশি আমদানি করতে হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে। যদি কৃষক সময়মতো সার না পায়, তাহলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি খরচও বেড়ে যাবে। এতে খাদ্যপণ্যের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। বিগত প্রায় এক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। যে শাকসবজির মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে থাকত, তা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। সাধারণ মোটা চালের দামও বিগত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারকে এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকের উৎপাদন সক্ষমতা ধরে রাখতে সার ও সেচসহ অন্যান্য উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।