শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৬ অপরাহ্ন

ননসেন্স ও বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকায় শিশুসাহ্যিতিক সুকুমার রায়

সমাদৃতা
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বাংলা সাহিত্যে শিশু ও কিশোর সাহিত্যিক বলতে মনে পড়ে যার নাম সুকুমার রায়। শিশুসাহিত্য, হাস্যরসে তো বটেই, বিদ্রুপের সুরে সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা বলতে পারাতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের তুলনা কেবল তিনি নিজেই। কিন্তু শুধুই কি তিনি শিশু মনের শিল্পী! তিনি একাধারে যেমন ছিলেন শিশুসাহিত্যিক, রম্য লেখক, নাট্যকার, কার্টুনিস্ট অন্য দিকে প্রথম ননসেন্স-এর প্রবর্তক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধের রচয়িতা। তাঁর অবিমিশ্র হাস্যরসের ধারায় সমস্ত বাংলা সাহিত্য অভিষিক্ত, সঞ্জীবিত। তাঁর সৃষ্ট ভাব সমাবেশের অভাবনীয় সংলগ্নতা আজও চমৎকৃতী আনে। তাঁর হাস্যরসের জোয়ারে শিশু-বৃদ্ধ সমানভাবে হাবুডুবু খায়। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন অনায়াসে। সুকুমার রায়ের মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা ‘নদী’ , প্রকাশিত হয় ‘মুকুল পত্রিকার ১৩০২ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। আনন্দ কুড়ানোর উপাদানই ছিল তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য। কালি কলমের আঁচড়ে তাঁর তৈরি চমৎকার সব কার্টুন ও ড্রয়িং ছিল তাক লাগিয়ে দেবার মত। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়ের নাম।
শুধু জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক নয়, বাংলা ভাষায় ননসেন্সেরও প্রথম প্রবর্তকও যে তিনি এই বিষয় অনেকেরই অজানা। সুকুমার রায়ের প্রথম এবং একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল যা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল “সাড়ে বত্রিশ ভাজা” নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর “মানডে ক্লাব” নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। আধুনিক সাহিত্যে ননসেন্সের কোনো স্থান ছিল না। আধুনিক সাহিত্য মানেই ছিল বড়দের সাহিত্য। মূলত রহস্য, রোমাঞ্চ আর রোমান্সÍবড়দের সাহিত্য ভাবনায় এই তিনটি বিষয়ই অনেক বড় জায়গাজুড়ে ছিল। ব্রিটিশ সাহিত্যিক এডওয়ার্ড লিয়র উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে লিখেছিলেন “বুক অব ননসেন্স” নামক একটি বই। এই বইটির হাত ধরেই প্রথম শিশুরা সাহিত্যে পেয়েছিল এক নিয়মছাড়া দেশের খোঁজ। ননসেন্সকে দুনিয়াভর জনপ্রিয় করার পেছনে আরো একটি বড় হাত লুই ক্যারলের। ১৮৬৫ সালে তিনি “অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” নামের যে অদ্ভুত ও উদ্ভট উপন্যাসটি লিখেছিলেন, তা আজও ছেলে-বুড়ো সবার কাছে জনপ্রিয়। নানা কমিকস, কার্টুন আর সিনেমার কল্যাণে এই উপন্যাসের জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। ইংরেজিতে যেমন ক্যারল,এডওয়ার্ড লিয়র বাংলায় তেমন সুকুমার রায়। তিনি বাংলা ননসেন্স সাহিত্যের রাজকুমার। সুকুমার তাঁর ‘ননসেন্স’ ও উদ্ভট ধরণের রচনায় এডওয়ার্ড লিয়রের অ ইড়ড়শ ড়ভ ঘড়হংবহংব, লুইস ক্যারলের অষরপব রহ ডড়হফবৎষধহফ প্রভৃতি লেখার দ্বারা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়েছেন, আবার হয়ত রয়েছে চ্যাপলিনের খামখেয়ালিপনার প্রভাবও। কিন্তু তার লেখায় যেন তাঁর সৃষ্ট উদ্ভট চরিত্র ও ছবিগুলি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ, সুপ্রযুক্ত ও ঘরোয়া। তবে শুধু ননসেন্স নয়, সুকুমার তাঁর সাহিত্যে ছোটদের জন্য এমন এক বিচিত্র জগৎ গড়ে গেছেন, তার আনন্দ থেকে যে বঙ্গশিশু বঞ্চিত হয়েছে, দুর্ভাগাই বলতে হবে তাকে। সন্দেশ পত্রিকায় তার অপর একটি অবদান ছিল তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলি। ছোটদের উপযোগী করে সহজ ভাবে তিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন অজস্র রচনার মাধ্যমে। নিজে বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র হওয়ায় এ কাজটা তিনি অনায়াসে সাবলীল ভঙ্গীতে করতে পেরেছেন। এ বিষয়ে তাঁর প্রথম লেখা প্রবন্ধ ‘সূক্ষ্ম হিসাব’। ১৩২৫ কার্ত্তিক সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘বেগের কথা’। অনেক সহজ ভাবে ছোটদের তিনি উপমা সহকারে ‘বেগ’ ও ‘বল’ সম্বন্ধে বুঝিয়েছেন তার সামান্য উদাহরণ –“তাল গাছের উপর হইতে ভাদ্র মাসের তাল যদি ধুপ করিয়া পিঠে পড়ে তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়; কিন্তু ঐ তালটাই যদি তাল গাছ হইতে না পড়িয়া ঐ পেয়ারা গাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, বেগ কম হইত। কোন জিনিস যখন উপর হইতে পড়িতে থাকে তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে। ৃ”।
তবে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বের হওয়ার নয় দিন আগে সুকুমার রায় এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান ‘কালাজ্বর’এ আক্রান্ত হয়ে। এত কম সময়েও সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। আরও অনেকদিন সাহিত্যচর্চার সুযোগ পেলে যে বাংলা সাহিত্যকে আরও কত কিছু তিনি দিতে পারতেন সেটা বলাই বাহুল্য। বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য যে তাঁর মতো প্রতিভাবান কবিকে এত কম সময়ে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী! তার লেখনী থেকেই নিঃসৃত হয়েছে যে তার মৃত্যু নেই।
“দেহ নহে মোর চির নিবাস,
দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ”।
তাঁর লেখনীর এই বিশ্বাসকে সঙ্গে করেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই প্রাণোচ্ছল, কর্মচঞ্চল, আনন্দময় মানুষটি তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্য কীর্তির মধ্য দিয়ে চিরভাস্বর হয়ে আমাদের মধ্যে বিরাজ করবেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com