সারা বিশ্বে ড্রোনের জয়জয়কার। ড্রোন দিয়ে চলছে সব কিছু। কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বর্ধিষ্ণু এই বিষয়টিকে আটকে রাখার জন্য নানা নিয়মকানুন আনা হয়েছে। যার বেশিরভাগই ইউজার ফ্রেন্ডলি নয়। ব্যবহারকারীর সুবিধা-অসুবিধা দূর করার চেয়ে এসব নিয়ম পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পেশাজীবীরা ড্রোন ব্যবহার করতে গিয়ে নানা সমস্যা মোকাবেলা করছেন। এসব দূর না করে বরং আরও কঠোর বিধিবিধান আনা হচ্ছে।
বর্তমানে ২০২০ সালের নীতিমালা দিয়ে ড্রোন ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই নীতিমালা নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনের বিধিমালা দরকার। কার হচ্ছেও তাই। দেশের খুব কম আইন, বিধি বা নীতিমালা ব্যবহারকারীদের সুবিধার দিকে নজর দিয়ে প্রণয়ন করা হয়। এসব আইনকানুন প্রশাসনের সুবিধার দিকে নজর দিয়েই প্রণয়ন করা হয়। আর একারণেই এসব নিয়ম-কানুন কালাকানুনে পরিণত হয়। সাধারণ ব্যবহারকারীদের খুব একটা উপকারে লাগে না।
এবার নীতিমালা থেকে বিধিমালা করা হচ্ছে। এ বিধিমালা করার সময় ব্যবহারকারীদের সাথে কথা বলা হয়নি। অথচ বৈঠক করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের ডেকে। তারা সবাই তাদের সুবিধার দিকে নজর দিয়েই বিধিমালা করার জন্য মতামত রাখছেন। বর্তমান নীতিমালায় ৫ কোজি ওজনের ড্রোন ওড়াতে হলে অনুমতি লাগে। আর যে বিধিমালা করা হচ্ছে তাতে ২৫০ গ্রাম ওজনের ড্রোন ওড়াতেই অনুমতি লাগবে। কাদের অনুমতি লাগবে? মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনারের। আর মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে লাগবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের। কিছু ক্ষেত্রে তা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আড়াইশ গ্রাম ওজনের ড্রোন হচ্ছে খেলনা ড্রোন। এগুলো ওড়ানোর জন্য যদি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগে তাহলে কারো পক্ষে কি ড্রোন ওড়ানো সম্ভব হবে? এদেশের কয়জন মানুষ পুলিশ কমিশনার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় মাড়াতে চান? চরম বিপদে না পড়লে এদেশের মানুষ ওমুখো হয়না।
সাংবাদিকরা ড্রোন ওড়ান তাদের পেশাগত প্রয়োজনে। এই ড্রোন ওড়ানোকে বিনোদন শ্রেণীতে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছে একটি সংস্থা। পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণ আর সাংবাদিকদের ড্রোন ওড়ানো কি এক হলো? দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে তখন সাংবাদিকরা ড্রোন দিয়ে ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ করেন। অন্যায়ভাবে যারা সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করতে চায় তাদের চিহ্নিত করার কাজে এ ড্রোন ব্যবহার করা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল যেন গণহারে সরকারকে কোন বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী করতে না পারে তার চিত্রায়নের জন্য ড্রোন ব্যবহার করা হয়। শুধু কি তাই? সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের ছবি তোলা হয় এই ড্রোন দিয়ে। সরকারের অন্যতম প্রধান সাফল্য পদ্মা সেতু। এর নান্দনিক ছবি যা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা তোলা হয়েছে ড্রোন দিয়ে। শহরের বুক চিড়ে যে যাদুর মেট্রোরেল ছুটছে তার ছবি ওঠানো হয়েছে ড্রোন দিয়ে। এই ইতিবাচক সাংবাদিকতাকে রুখে দেওয়ার জন্যই কি মাত্র আড়াইশ গ্রাম ওজনের ড্রোন ব্যবহার করতে হলে অনুমতির আওতায় আনা হচ্ছে? যে সাংবাদিকতার ওপর তাবৎ পৃথিবীর নির্ভরতা সেই সাংবাদিকতাকে দেশে আরও বিতর্কিত করার জন্যই কী সাংবাদিকদের ড্রোন ব্যবহারকে বিনোদন শ্রেণীতে ফেলার প্রস্তাব করা হয়েছে?
বর্তমান নীতিমালায় আছে কোন এলাকায় ভিভিআইপি ভ্রমণ করলে তার তিন দিন আগে থেকে ড্রোন ওড়ানো যাবে না। কিন্তু প্রস্তাবিত বিধিমালায় বিষয়টিকে কঠোর থেকে কঠোরতর করা হয়েছে। খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে যেকোনো এলাকায় ড্রোন ওড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট পাঁচ কিলোমিটারে ভিআইপি মুভমেন্ট আছে কিনা তা নিজ দায়িত্বে ড্রোন অপারেটরকে জানতে হবে। ভিআইপি মুভমেন্টের তিন দিন আগে থেকে ড্রোন উড্ডয়ন বন্ধ থাকবে।
বিদ্যমান নীতিমালায় কিছু ক্ষেত্রে ড্রোন ওড়ানোর এখতিয়ার সিভিল এভিয়েশনের কাছে রাখা হয়েছে। রাতে ড্রোন পরিচালনার বিষয়টিকেও সিভিল এভিয়েশনের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে অনেক সংস্থা। এমনকি দিনেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ড্রোন পরিচালনার অনুমতি সিভিল এভিয়েশন থেকে নেওয়ার সুপারিশ করছে। কিন্তু এটা কি বাস্তবসম্মত? দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া ড্রোন ওড়ানোর আবেদনগুলো কি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে পারবে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি? আর সেসব আবেদন নিষ্পত্তি করার সময় স্থানীয় বাস্তবতাকে আমলে নেওয়াও সম্ভব না সিভিল এভিয়েশনের পক্ষে।
গত ১৮ জানুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুকের সভাপতিত্বে ড্রোন বিধিমালা প্রণয়ন বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে খসড়া বিধিমালা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে তাদের মতামত চাওয়া হয়। সেসব মতামত আসতে শুরু করেছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘ড্রোনের ব্যাপারে আমাদের আরও স্বচ্ছতা দরকার। প্রযুক্তির এই যুগে এটাকে প্রয়োজন অনুযায়ী সহজে ব্যবহার করতে দিতে হবে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন ড্রোনের ব্যবহার আছে।’
বিশ্বব্যাপী কৃষির উন্নয়ন, আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ, ফসল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, মশার ওষুধ স্প্রে, বিভিন্ন সার্ভের জন্য চিত্র ধারণ, চলচ্চিত্র নির্মাণ, জরুরি সাহায্য প্রেরণ, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে দূর নিয়ন্ত্রিত ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশেও বেসরকারি পর্যায়ে মানুষ-বিহীন এ আকাশযান ব্যবহার করা হচ্ছে। একারণেই ২০২০ সালে ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ড্রোনের ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য নীতিমালা থেকে বিধিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। বর্তমানে সাংবাদিকতা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখাশোনা, পারিবারিক অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণ করতে ড্রোন বা ফ্লাইং রোবট ব্যবহার করা হয়। রাতে সমন্বিত পরিচালনার মাধ্যমে মনোজ্ঞ ডিসপ্লে তৈরিতেও ড্রোন ব্যবহার হয়। তাছাড়া ইউটিউবার ও টিকটকাররা তাদের কনটেন্ট ক্রিয়েশনের জন্য ড্রোন ব্যবহার করে। আরও নানা সেক্টরে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে দিন দিন।