শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ অপরাহ্ন

‘খালিস্তান’ নিয়ে কেন ভারত-কানাডার সম্পর্কের অবনতি হলো

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টে ভারতের দিকে সরাসরি আঙ্গুল তুলে বলেছেন, তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে যে ভারত সরকারের গুপ্তচরেরা এক কানাডিয় নাগরিককে হত্যার সাথে জড়িত। নিহত ওই শিখ ব্যক্তি ভারতে একজন ‘ঘোষিত সন্ত্রাসী’ ছিলেন। কানাডা ভারতের দিকে ওই গুরুতর অভিযোগ তোলায় যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে তারা কানাডার নাগরিকের হত্যা তদন্তের দিকে নজর রাখছে। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের একটি শিখ গুরুদ্বারের বাইরে গত ১৮ জুন গুলি করে হত্যা করা হয় হরদীপ সিং নিজ্জারকে। গত সোমবার কানাডার হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, ‘কানাডার নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার সাথে ভারত সরকারের গুপ্তচরদের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ নিয়ে কানাডার নিরাপত্তা অ্যাজেন্সিগুলো বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করছে।’
পার্লামেন্টের ভাষণে ট্রুডো, ‘কানাডার গভীর উদ্বেগের কথা ভারত সরকারের শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। গত সপ্তাহে জি২০ সম্মেলনের মধ্যে বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছি।’ ওই ভাষণের পরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জলি ঘোষণা করেন, এক শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিককে তারা বহিষ্কার করছে। ভারতের সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ওই কূটনীতিক পবন কুমার রাই ভারতের বহির্দেশীয় গুপ্তচর অ্যাজেন্সি আর অ্যান্ড এ ডব্লিউয়ের অফিসার।
হরদীপ সিং নিজ্জারকে হত্যার সাথে ভারত সরকারের জড়িত থাকার গুরুতর এই অভিযোগকে দিল্লি ‘মনগড়া’ এবং ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে নাকচ করে দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেন, ‘এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ খালিস্তানি সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। যারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখ-তার প্রতি একটা হুমকি, তাদের কানাডায় আশ্রয় দেয়া চলছে।’ এরপরে মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেকে পাঠান দিল্লিতে কানাডার রাষ্ট্রদূত ক্যামেরুন ম্যাকেকে। কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়।
পশ্চিমা কূটনীতিক বহিষ্কার বিরল: ভারত আর কানাডার মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক নেই, তবুও দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয়েছে যে একে অপরের একজন করে শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। সম্প্রতি জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকও করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। তবে ওই শীর্ষ সম্মেলনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকা- নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করার কারণে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা আরো বেড়ে যায়। দেখা গেছে যে শীর্ষ সম্মেলনের সময় ট্রুডো নরেন্দ্র মোদির সাথে করমর্দন করেই দ্রুত সেখান থেকে সরে যান। এরপর জাস্টিন ট্রুডোর সাথে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকে কানাডায় খালিস্তানপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠনের কার্যকলাপের বিষয়টি উত্থাপন করেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মোদি। তবে জাস্টিন ট্রুডো বলেন, কানাডা সবসময় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করবে।
তার মতে, এটি এমন একটি বিষয় যা কানাডার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার সহিংসতা প্রতিরোধ এবং বিদ্বেষ কমাতেও কানাডা সবসময়েই প্রস্তুত। তার কথায়, ‘এটাও মনে রাখতে হবে যে কিছু ব্যক্তির কর্মকা- সমগ্র কানাডিয়ান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না।’
জি২০ সম্মেলন থেকে ফেরার সময়ে ট্রুডোর বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। ওই সময়ে নরেন্দ্র মোদি এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান নামের যে বিশেষ বিমানটি ব্যবহার করেন, সেটিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিতে চেয়েছিল ভারত।
তবে ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কানাডা। দু’দিন দিল্লিতে অপেক্ষা করতে হয় জাস্টিন ট্রুডোকে। আর তিনি দেশে ফেরার পরেই কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজির এক মুখপাত্র জানান, দ্বি-পক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তা স্থগিত করা হচ্ছে। দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক চন্দন নন্দি, যিনি ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী কাজকর্ম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেদন করেন, তিনি বলছেন, ‘দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যা আবারো ঠিক হতে অনেক সময় লেগে যাবে। গত তিন দশকের মধ্যে এমন ঘটনা মনে পড়ছে না যেখানে কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ পাশ্চাত্যের দেশ ভারতের কূটনীতিককে বহিষ্কার করে দিয়েছে। অতি বিরল ঘটনা এটা।’
সম্পর্কের ধারাবাহিক অবনতি
খালিস্তানীদের ইস্যু নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই ভারত আর কানাডার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। ভারত বলে আসছে যে খালিস্তানপন্থীদের কাজকর্ম কানাডা ছাড়া যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যেই ওই তিন রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। ভারতের থিংক ট্যাঙ্ক অবসার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও লন্ডনের কিংস কলেজে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হর্ষ পন্থ বলেন, ‘ভারত সরকার মনে করে এবং সেটা তারা জাস্টিন ট্রুডোর সরকারকে বারে বারে বলেছে যে খালিস্তান সমর্থকদের কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করুক কানাডার সরকার।’
খালিস্তান আন্দোলন কী? গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক খালিস্তানের দাবি উঠতে শুরু করলেও তা আন্দোলনে রূপ নেয় সত্তর আর আশির দশকে। শিখদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির চত্বর থেকে ওই আন্দোলন পরিচালিত হতো। আটের দশকের শুরু থেকে ওই আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে, অস্ত্র মজুত করা হতে থাকে মন্দির-সংলগ্ন ভবনগুলোতে। ওই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ১৯৮৪ সালের ১ জুন স্বর্ণমন্দির চত্বরে সেনা প্রবেশ করে, শুরু হয় অপারেশন ব্লু স্টার। সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে শীর্ষ খালিস্তানি নেতা জার্নেইল সিং ভিন্দ্রনওয়ালেসহ বহু খালিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হন।
সরকারি হিসাবে ওই অপারেশনে ৮৩ জন সেনা সদস্য ও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বেসামরিক নাগরিক সহ ৪৯২ জন নিহত হয়েছিলেন বলে ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা তাদের একটি পুরনো প্রতিবেদনে লিখেছে। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, নিহতের সঠিক সংখ্যা অনেকগুন বেশি। ১০ দিনের ওই সেনা অপারেশনের বিরুদ্ধে সারাবিশ্বের শিখ সম্প্রদায় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, তারা মনে করেন যে এই অপারেশন তাদের ধর্মের প্রতি সরাসরি আঘাত। অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন সেনা ছাউনিতে অবস্থানরত শিখ সৈন্যদের একটা অংশ বিদ্রোহ করে। তাদের অনেককে সেনাবাহিনীর অন্য রেজিমেন্টের সদস্যরা গ্রেফার করে যাদের পরে কোর্ট মার্শাল হয়। অনেক বিদ্রোহী শিখ সেনা সদস্য গুলিতে নিহতও হন। অপারেশন ব্লু স্টারের কারণেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয় ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। তারপরে ভারতব্যাপী শিখ বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়, যাতে এক হাজারেরও বেশি শিখ নিহত হয়। ওই দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ ছিল কংগ্রেসের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে। সূত্র : বিবিসি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com