বাইরে বন্দুকের গোলাগুলির শব্দ শুনে সাঈদ পড়া শেষ না করেই উঠে দাঁড়ায়। মা বাধা দিয়ে বললেন, ‘এখন বাইরে যেও না, প্রচ- গোলাগুলি হচ্ছে।
: ‘মা ওরা আবার আমাদের ঘর ভেঙে দিবে, ওদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে..’ সাহসে বুক ফুলিয়ে বলে ছোট সাঈদ।
: ‘বাবা তুমি অনেক ছোট। রুশ সৈন্যদের হাতে আছে বুলেট। ওরা ঘোড়ায় চড়ে আসে। তুমি ওদের সাথে পারবে না।’ মা নূরিয়া হানিম সাঈদকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন।
: ‘মা আমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে লড়তে হবে। হয় তো ওরা আবার আমাদের ঘর গুঁড়িয়ে দেবে। আরো মানুষ মারবে।’
সাঈদকে আরো শক্ত করে বুকের আরো কাছে নিয়ে মমতাভরা গলায় মা বলেন: ‘বাবা লড়াই শুধু বন্দুক, বুলেট আর ঘোড়া দিয়ে হয় না। বুদ্ধিও লাগে। তোমাকে অনেক অনেক লেখাপড়া করতে করতে হবে। আরো অনেক কিছু জানতে হবে। তারপর যুদ্ধে নামলেই তুমি বিজয়ী হবে। শুধু সাহস করে খালি হাতে শত্রুর সামনে দাঁড়ানো মস্ত বড় বোকামি।
মায়ের কথায় সাঈদ শান্ত হয়ে বসে। ততক্ষণে বাইরের গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। সাঈদ মায়ের সাথে দেয়ালের ফুটো দিয়ে বাইরে তাকায়। ধূলি উড়িয়ে কয়েকটি ঘোড়া দ্রুতগতিতে পাহাড়ের দিকে ছুটছে। সাঈদ অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর মাথায় একটাই চিন্তা। তাকে যুদ্ধ করে জিততে হবে।
সাঈদ ভাবছে শুধু শক্তি আর অস্ত্র দিয়ে লড়াই করে জিতা যায় না। লড়াইয়ে জিততে হলে অনেক অনেক জ্ঞান ও বুদ্ধির দরকার। দ্রুতগতির শক্তিশালী ঘোড়া, বন্দুক, বুলেটের সাথে আরো দরকার আল্লাহর সাহায্য। তবেই লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়া যায়। তাই তাকে পড়তে হবে। আরো জানতে হবে। জ্ঞানের আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে হবে। আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কেমন ছিলেন? কেমন ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. তাও জানতে হবে।
সাঈদ আস্তে আস্তে শান্ত মনে ধীর পায়ে ওর পড়ার টেবিলের কাছে আসে। তারপর একটা বই হাতে নেয়।
২.
পূর্ব তুরস্কের উত্তর আস্তালিয়ার বিতলিস প্রদেশের খিযান এলাকার ছোট গ্রাম নুরসে। গ্রামটি খুব সুন্দর। গ্রামটির পুবদিকে বিশাল খাড়া পাহাড়। শক্ত প্রাচীরের মতো এই পাহাড়টি ছোট গ্রামটিকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে বারবার রক্ষা করে। সাঈদ লেখাপড়ায় খুব ভালো। তার মেধায় মুগ্ধ বাবা মির্জা আফেন্দী। মির্জা আফেন্দী একজন কৃষক। কিন্তু ইসলামের গভীর জ্ঞানের কারণে তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা করেন। মা নূরিয়া হানিম এবং বাবা মির্জা আফেন্দীর কাছে ছোট সাঈদ খুবই আদরের। সাঈদ সময় পেলেই পবিত্র কোরআন হাদিস ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই নিয়ে ছুটে যায় মা, বাবা, ভাই যাকে যখন কাছে পায় তার কাছে।
: মা, এই আকাশ পৃথিবী পাহাড় কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? সাঈদ জানতে চায়।
সূরা ক্বাফ-এর ৩৮ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করে মা বলেন: “আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই দেখ তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি নভোম-ল, ভূম-ল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি এবং আমাকে কোনোরূপ ক্লান্তি স্পর্শ করে না’।”
সাঈদের আগ্রহ আরো বেড়ে যায় সে জানতে চায়: কেন আল্লাহ এসব সৃষ্টি করলেন..’
সাঈদের আগ্রহ দেখে তার বাবা তাকে মোল্লা মেহমেদ আমীন মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। কিন্তু মাত্র নয় বয়সের সাঈদের আকার অন্য ছাত্রদের চেয়ে সাইজে ছোট হওয়ায় মাদরাসার শিক্ষকরা তাকে আরো কিছু দিন বাসায় পড়ালেখা করানোর পরামর্শ দেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। সাঈদ দমে যাওয়ার মতো ছেলে না। সে তার ভাই আবদুল্লাহর বই নিয়ে পড়তে থাকে। তার মনে শত শত প্রশ্ন এসে ভিড় করে। প্রশ্নের উত্তর খোঁজে কোরআন-হাদিস আর বিজ্ঞানের বইয়ে। অবসর পেলেই চলে যায় বাড়ির পাশের পাহাড়ে। গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে পাখির কিচির-মিচির, ফুলে ফুলে প্রজাপতি, দূরের নীল আকাশ দেখে। চিন্তার সাগরে ডুব দিয়ে অজানাকে জানার আশায় সাঁতার কাটে। না বেশিক্ষণ সে চিন্তায় ডুবে থাকতে পারে না। আবার গুলির শব্দ। সাঈদ দ্রুত একটি পাহাড়ে গুহায় লুকিয়ে পড়ে।
ঘোড়ার হ্রেষা বর আর গুলির শব্দ ওর কানে আসছে। রাশিয়ার সৈন্যরা প্রায় প্রতিদিনই পাহাড়ঘেরা সবুজ গাছের ছায়ায় ঢাকা এই শান্ত নিবিড় গ্রামে হামলায় চালায়। ডাকাতের মতো ওদের গরু-ছাগল, গম, যব, বার্লি যা পায় লুট করে নিয়ে যায়। প্রতিরোধ করতে চাইলে গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
কেন এই যুদ্ধ? সাঈদ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে। সে ভাবে এবার নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারলে বাবাকে নয় তো বড় ভাইকে সে জিজ্ঞেস করবে।
আস্তে আস্তে পরিবেশ শান্ত হয়ে আসে। এখন আর গুলির শব্দ এবং ঘোড়ার খুরের আওয়াজ কিংবা হ্রেষা রব কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সাঈদ খুব সতর্কভাবে গুহা থেকে মাথা বের করে বাইরের চার পাশটা দেখে নেয়। কিন্তু বের হয় না। আরো কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে। দূর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। ওর বুকের ভিতরের কষ্টগুলো বিদ্রোহের আগুনে পরিণত হয়। সে বুঝতে পারে। শত্রুসেনারা আশপাশে নেই। কিন্তু যাওয়ার আগে এবারও গ্রামের কাউকে না কাউকে হত্যা করে গেছে, নয় তো বড় কোন ক্ষতি করেছে। সাঈদ আল্লাহু আকবর বলে গুহা থেকে বের হয়ে আসে। দ্রুত হাঁটতে থাকে যেদিক থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে সেই দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সাঈদ পৌঁছে যায় সেখানে।
পাহাড়ের ওপরে আবদুল গনি আফেন্দীর বাড়িতে রুশ সেনাদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে সাঈদের ছোট মনের আগুনটা আরো বেগে জ্বলে ওঠে।
: চাচা, ঐ জানোয়ারগুলোকে আর ছাড় দেয়া যাবে না, আমাদেরও লড়বে হবে।
সাঈদের কথা শুনে আবদুল গনি আফেন্দীর কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। তিনি বলেন: ‘বাবা ওরা টাকা, গরু দুম্বা নিয়ে গেছে গমের গুদামে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সব পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। মেয়ে আর ছেলেটাকেও খুঁজে পাচ্ছি না। আল্লাহই জানেন ওদের কী হয়েছে..’
: চাচা চিন্তা করবেন না, ওরা হয় তো আশপাশের কোথায় লুকিয়েছে, আসুন খুঁজে দেখি।’ সাঈদের কথায় গনি আফেন্দী মনে জোর পান। তিনি সাঈদকে সাথে নিয়ে আশপাশের পাহাড়ের গুহা এবং জঙ্গলে খুঁজতে বের হন।
:‘ আহমেদ, আহমেদ, আলিয়া…’ সাঈদ ও গনি আফেন্দী গলার আওয়াজ দূর পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।
৩.
না। আহমেদ ও আলিয়ার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। গনি আফেন্দী হতাশ হয়ে বসে পড়েন। সাঈদ তাঁকে সান্ত¡না দেয়
: আপনি ভেঙে পড়বেন না। আল্লাহকে ডাকুন। ওরা যেখানেই থাকুক আল্লাহ যেন ওদের নিরাপদে রাখেন।’
গনি আফেন্দী উচ্চ সুরে আয়াতুল কুরসি এবং দরুদ শরিফ পড়েন, তারপর দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেন। সাঈদও ওনার সাথে হাত তুলে।
‘আল্লাহু আকবর… আল্লাহু আকবর..’ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে পূর্ব সীমান্তের দিকে।
: ‘চাচা সুলতানের টহল সেনারা মনে হয় এদিকে আসছে..’ চলুন আমরা ওদের কাছে যাই। আল্লাহু আকবর আওয়াজ এবং ঘোড়ার খুরের শব্দ আরো স্পষ্ট হচ্ছে। সাঈদ ও গনি আফেন্দী সৈনিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আল্লাহু আকবর … স্লোগান তুলে। সৈনিকরা দ্রুত ওদের কাছে চলে আসে। টহলদলের কমান্ডার গনি আফেন্দীকে দেখেই চেনে ফেলেন। তিনি টহলে এসে অনেকবার ক্লান্ত হয়ে ওনার বাড়িতে চা পানি খেয়েছেন। গনি আফেন্দী এই এলাকার একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ। সবাই তাকে সম্মান করেন। কমান্ডার ঘোড়া থেকে নেমে তাঁকে সালাম দেন: ‘আসসালামু আলাইকুম, আপনাকে বহুত পেরেসান মনে হচ্ছে? নিশ্চয় জালেমগুলো আপনার ক্ষতি করেছে।’
গনি আফেন্দী কান্নার চাপ আর চেপে রাখতে পারেন না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন: ‘আমার আহমেদ ও আলিয়াকে …’ তিনি আর বলতে পারেন না।
কমান্ডার বলেন. ‘আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। চলুন ক্যাম্পে যাই। আমাদের টহল দল রুশ সেনাদের ধাওয়া করেছিল। ওরা পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেক কিছু ফেলে গেছে। ওখানে আহত একটি ছেলে ও মেয়েও আছে বলে দূত আমাকে জানিয়েছে। আমি দেখলেও অবশ্য ওদের চিনতে পারতাম। আমি তো আপনার বাড়িতে অনেক বার গিয়েছি। ওরা আমাদের মেহমানদারি করছে। আর কথা নয় চলুন। কমান্ডার দুইজন সিপাইকে বললেন, ‘তোমরা এখানে পাহারায় থাক। একটা ঘোড়া দাও।’ তিনি সাঈদকে বলেন, ‘আমার ঘোড়ার পিঠে বস।’ আফেন্দী আপনি ঐ ঘোড়াটা নিন।’ সৈনিকদের ঘোড়াটি দেখিয়ে গনি আফেন্দীকে সওয়ার হতে বলেন।
৪.
টগবগ টগবগ করে দ্রুত গতিতে ঘোড়া চলছে। ক্যাম্প বেশি দূরে নয়। দশ-পনের মিনিটের মধ্যেই সবাই ক্যাম্পে চলে আসে। কমান্ডারকে দেখে পাহারায় থাকা সিপাইরা সালাম জানিয়ে গেট খুলে দেয়। ক্যাম্প ইন চার্জ সালাম দিয়ে সামনে এগিয়ে এলে কমান্ডার তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘রুশ হানাদাররা কী কী রেখে পালিয়েছে? তাদের জিম্মায় কোন মানুষ আছে কি? ’
: হ্যাঁ আছে। ১০-১১ বছর বয়সের একটি ছেলে ও মেয়ে অজ্ঞান অবস্থায় হেকিমের কাছে আছে। তিনি তাদের জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করছেন। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করা হচ্ছে না, জনাব।’
: বহুত আচ্ছা। এই যে আমার সাথে যাকে দেখছো উনি খিযানের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই সুলতানি খেলাফতের বিশ্বস্ত বন্ধু আবদুল গনি আফেন্দী। রুশ হানাদাররা আজ ওনার বাড়িতে হানা দিয়েছিলো। ওনার ছেলে ও মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না।
: ‘চলুন দাওয়াখানায়। আমার মনে হয় ওরা ওনারই সন্তান।’ ক্যাম্প ইন চার্জ কমান্ডারকে বলেন।
: ‘আল হামদুলিল্লাহ।’ আবদুল গনি আফেন্দী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে কমান্ডারের সাথে দাওয়াখানার দিকে পা বাড়ান।
পাহাড়ের ওপরে সুন্দর করে সাজানো এই টহল চৌকি। সৈনিকদের থাকার ঘর, ঘোড়ার আস্তাবল, অস্ত্রাগার, দাওয়াখানা সবই আছে। গোটা ইউরোপের সাথে লড়ে তুরস্ক খেলাফতকে টিকিয়ে রাখতে সুলতানরা গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সেনাবাহিনী। প্রতিটি চৌকিতে দক্ষ ও যোগ্য চৌকিদার নিযুক্ত করেছেন। সিপাইদের সুযোগ সুবিধার কোন ঘাটতি রাখেননি। কিশোর সাঈদ সবকিছু সূক্ষ্মভাবে দেখছে। আর ভাবছে। তারপরও কোন সাহসে রুশ ও ইউরোপের দেশগুলো বারবার হানা দেওয়ার সাহস পায়। সে মনে মনে ঠিক করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে। তুর্কী খেলাফতের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মনিয়োগ করবে। মাদরাসার উস্তাদদের কাছে সে জেনেছে রাসূল সা. বলেছেন, ‘দুটি চোখ জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে না: ১. যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে ২. যে চোখ রাত জেগে কোন মুসলিম দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পাহারা দেয়।’ সাঈদ আল্লাহর সেই সৌভাগ্যবান বান্দা হতে চায়। সে বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। বুলেট আর ঘোড়াই হবে আর সঙ্গী।
কমান্ডারের সাথে আবদুল গনি আফেন্দী ও সাঈদ দাওয়াখানার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। বাইরে দুইজন সৈনিক পাহারা দিচ্ছেন। কমান্ডারকে দেখে তারা সালাম দিয়ে গেট খুলে দেয়। দাওয়াখানার সামনে আহতদের বহন করার জন্য দুটি দুইঘোড়ায় টানা গাড়ি। সুন্দর কারুকার্যময় ভবনের সামনে ফুল-ফলের বাগান। কমান্ডারকে দেখে সিপাইয়ের পোশাক পরা দুইজন লোক এগিয়ে আসেন।
তারা তাদের সালাম দেন। কমান্ডার আফেন্দীর সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন দিয়ে বলেন; ‘জনাব আফেন্দী ওনারা দুইজনই বড় হেকিম আবার সৈনিক হিসেবেও দক্ষ। ঘোড়া-অসি, তীর, বন্দুক চালানো এবং মল্লযোদ্ধা হিসেবেও এই ক্যাম্পে ওনাদের খ্যাতি আছে।’
হেকিমরা ওনাদের নিয়ে প্রথমে ছেলেদের ওয়ার্ডে যান ১০ নম্বর বেড়ে শুয়ে আছে আহমেদ এতক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে। তারপর একজন সৈনিক প্রথমে রুশ সৈনিকদের হাত থেকে উদ্ধার করা কয়েকজন মেয়ের স্কেচ আবদুল গনি আফেন্দীকে দেখিয়ে জানতে চান, ‘এখানে আপনার মেয়ে আছে কি না দেখুন।’
একটি ছবি হাতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই তো আমার মা আলিয়া। কেমন আছে? কোথায় আছে?’
: ‘জনাব, উতলা হবেন না। উনি ভালো আছেন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন তিনি জালেমদের হাত থেকে উনাকে উদ্ধার করেছেন। উনাকে মেয়েদের ওয়ার্ডে মহিলা হেকিমরা চিকিৎসা দিচ্ছেন। সেখানে ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ। একটু বসুন। দেখি উনি হাঁটা চলার মতো অবস্থায় থাকলে আপনার সাথে দেখা করে যাবেন।’ এ কথা বলে ঐ সৈনিক চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আলিয়া এসে বাবাকে সালাম দিয়ে বলে: ‘বাবা আমি এখন ভালো আছি। ভাইয়া কেমন আছে?’
: ‘তোমার ভাইয়াও ভালো আছে।’
: বাবা আপনি তাহলে এখন বাড়ি যান। মা চিন্তা করছেন। হেকিম সাহেবা বলেছেন, আমাকে আরো দুইদিন এখানে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।
৫.
সাঈদের মাথায় হাজারো প্রশ্ন আসে। বাবা আর বড় ভাইয়ের সংগ্রহে থাকা বইয়ের পাতায় এবং আল কোরআনে খুঁজে তার মনের অজানা প্রশ্নের উত্তর। সে বুঝতে পারে কুরআনই প্রকৃত অগ্রগতি এবং সভ্যতার উৎস। আবারও মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া। কিশোর বয়সে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করে সবাইকে অবাক করে দেয়। ছাত্র হিসেবে সে খুবই মেধাবী। কোনো বিষয় মুখস্থ করতে তাঁর বেশি সময় লাগে না। তার স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার পড়লেই মুখস্থ হয়ে যায়। আকারে ছোট হওয়ার কারণে মোল্লা মেহেমদে আমীন আফেন্দিীর মাদরাসা ত্যাগ করার কয়েক বছর পর ভর্তি হয় বায়েজীদ মাদরাসায়। সেখান থেকে চলে আসেন শিরতে। এখানে এসে ভর্তি হন মোল্লা ফতেউল্লাহ আফেন্দীর মাদরাসায়। এটি তুরস্কের একটি বিখ্যাত মাদরাসা। এই মাদরাসায় অধ্যয়নের সময় সাঈদ ইবনুল সুবকির লেখা ইসলামের আইন শাস্ত্রের চার মাজহাবের মূলনীতি নিয়ে লেখা গবেষণা গ্রন্থটি মুখস্থ করে ফেলে প্রতিদিন মাত্র দুই ঘণ্টা করে পড়ে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করা সাঈদ ধর্মতত্ত্বের উপর অগাধ পা-িত্য লাভ করেন। তার জ্ঞান ও প্রতিভার কারণে মোল্লা ফতেহউল্লাহ সিরাজী তাকে ‘বদিউজ্জামান’ বা সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। কিশোর সাঈদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা তুরস্কে। দেশের বিভিন্ন সেরা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেয়। সাঈদ বিতলিসের মারদীন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানও করেন। কিন্তু না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেয়ালে বন্দি থাকতে রাজি নয় সাঈদ। দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে শুধু কলমের শক্তিতে কাজ হবে না। তার চাই বুলেট আর ঘোড়া। রুশ আগ্রাসন থেকে প্রিয় জন্মভূমি তুরস্ককে বাঁচাতে এর বিকল্প নেই।
রাশিয়া দাবি করছে সাঈদের প্রিয় জন্মভূমি পূর্ব তুরস্কের উত্তর আস্তালিয়ার বিতলিস প্রদেশ। তাদের দাবি এটি আর্মেনিয়ার অংশ। ইউরোপের খ্রিস্টান শক্তির দাপটে রাশিয়া দখল করতে চায় তার প্রিয় জন্মভূমি। এই ভূমি রক্ষা করা তার ঈমানের দাবি। এই দাবি পূরণে সাঈদ শপথ নেয়। কারণ রাশিয়ার আগ্রাসনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। যদিও তুর্কী সুলতানের সেনাবাহিনী সীমান্তে সব সময় সতর্ক পাহারায় থাকে। কিন্তু এই এলাকাটা খুবই দুর্গম। পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা। রাশিয়ার লুটেরা বাহিনীর সৈন্যরা চোরাগুপ্তা পথে এসে আগ্রাসন চালায়। তা-ব চালিয়ে লুটপাট করে চলে যায়।
তুরস্কের উসমানী খেলাফতের আগের সেই দাপট নেই। ভিতরের বাইরের ষড়যন্ত্রে অনেকটাই ম্রিয়মান। সুলতান দ্বিতীয় হামীদ সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করছেন দক্ষতার সাথে। কিন্তু শুধু রাশিয়া নয় তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে গোটা ইউরোপকে।
সাঈদ বুঝতে পারে, ইউরোপের বুকে তুরস্ক ইসলামী খেলাফতের মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তা কিছুতেই মানতে পারছে না খ্রিস্টান ইউরোপ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আসা তুরস্কের মুসলিম তরুণদের একটি অংশও ভিন্নদেশিদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পায় দিয়ে ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে শামিল হচ্ছে। এদের ফিরাতে হবে। তাদের মাঝে জাগ্রত করতে হবে স্বকীয় জাতীয়তাবোধ। একজন মুসলিম যুবক হিসেবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতে না পারলে গোটা তুরস্কই একদিন হারিয়ে যাবে।
৬.
মাত্র ১৪ বছর বয়স। তার মানে খুব সহজ এখনো সাঈদ কিশোর। কিন্তু এই বয়সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করছে সাঈদ। ‘ইজাযাত ইলমিয়্যাহ’ ডিগ্রি লাভ করেছে। বর্তমান সময়ের পিএইচডি সমমানের এই ডিগ্রি লাভ করায় সাঈদ বয়সে কিশোর হলেও জ্ঞানের দিকে থেকে পূর্ণ বয়স্ক। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার প্রজ্ঞা ও প্রভার কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ডাকেন ‘বদিউজ্জামান’ (‘সময়ের অদ্বিতীয় ও সবচেয়ে উচ্চ ব্যক্তি) বলে। সাঈদ এখন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাই তাকে আর তুমি আর নয় তিনিই বলতে হচ্ছে।
৭.
ছিমছাম একটি কামরা। সেলফে সাজানো পবিত্র কোরআন হাদিস ফিকাহসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বই। সেলফে জায়গা না হওয়ায় কার্পেটে এবং বিছানাতেও স্তূপ করে রাখা হয়েছে বড় বড় কিতাব।
জয়তুন তেলের প্রদীপের আলো জ্বলছে। সাঈদ মাগরিবের সালাত শেষ করে পত্রিকার পড়ছেন। এক এক জন করে তার ছাত্ররা আসছে। তারা যে যেখানে জায়গা পাচ্ছে তাকে ঘিরে বসছে।
সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে প্রায় প্রতিদিনই সাঈদের ড্রয়িং রুমে এমন আসর বসে। তিনি পত্রিকা থেকে মাথা তুলে ছাত্রদের বললেন: ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সেক্রেটারি ফর কলোনিজ (ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী) গ্ল্যাডস্টোন কী বলেছেন জানো?’
সবাই আগ্রহের সাথে জানতে চাইলো: ‘কী বলেছেন।’
সাঈদ পত্রিকা থেকে পড়ে ছাত্রদের শোনালেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সেক্রেটারি ফর কলোনিজ গ্ল্যাডস্টোন যখন ঘোষণা দিয়েছেন,so long as the Muslims have the Quran, we shall be unable to dominate them. We must take it from them, or make them, lose their love of it. না আর বসে থাকার সময় নেই। সংগ্রাম ছাড়া পরিবর্তন আসবে না।’
: ‘আমরা আপনার সাথে আছি। কী করতে হবে বলুন।’ ছাত্ররা সমস্বরে বলে।
: সবার আগে চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। আল কোরআন, হাদিস, ফিকাহ সাথে সাথে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পবিত্র কোরআনের জ্ঞান ধ্রুবসত্য তা প্রমাণসহ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের মাঝে তুলে ধরতে হবে।
: ‘আমাদের মাদরাসাগুলোতে তো বিজ্ঞান পড়ানো হয় না।’ একজন ছাত্র বলে।
: হ্যাঁ। আগে ভৌত বিজ্ঞান মাদ্রাসায় পড়ানো হতো। এটি বাদ দেয়ার কারণে আমরা পশ্চিমাদের অগ্রগতির তুলনায় পিছিয়ে পড়েছি।
: ‘এখন আমাদের কী করণীয়?’ একজন ছাত্র তাকে প্রশ্ন করে।
: সবার আগে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করব যেখানে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থাও থাকবে। সাঈদের ছাত্ররা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার আন্দোলন শুরু করতে সবাই রাজি হয়।
একটি নতুন তুরস্ক গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সভার কাজ শেষ হয়। শুরু হয় শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের আন্দোলন। সাথে ‘ইয়ং টার্কিশ মুভমেন্টের’-এর কাজ জোরদার করার ওপর জোর দেন।
ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে তুর্কী তরুণদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ভ্যান প্রদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন জেহরা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ঘোষণা করেন, “আমি পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করবো কোরআন নিঃশেষ হয়ে যাবার মতো কিছু নয়। এটা হলো এক শাশ্বত জীবনব্যবস্থা। এক অফুরান আলোর উৎস।”
৮.
তুমুল যুদ্ধ চলছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া এই তিন দেশ এক পক্ষে অন্যপক্ষে জার্মানি ও তুরস্কের উসমানীয় খেলাফত। পৃথিবীর আরো অনেক দেশ স্ব স্ব মিত্রদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় গোটা পৃথিবীই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়ার বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী তুরস্কের বিলতিস শহরে প্রচ- আক্রমণ চালায়। সাঈদ দেখলেন শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাশিয়ান আক্রমণে ভেঙে পড়ছে। তিনি ছাত্রদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে নিজেই শুরু করে প্রতিরোধ যুদ্ধ। কিন্তু রাশিয়ার প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী এবং আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সাঈদ আহত অবস্থায় রুশ বাহিনীর হাতে বন্দি হন।
রাশিয়ান বন্দি শিবির। রুশ জেনারেল নিকোলাস বন্দী শিবির পরিদর্শনে এলেন। সকল বন্দী দাঁড়িয়ে নিকোলাসকে সম্মান প্রদর্শন করেন। কিন্তু বদিউজ্জামান না দাঁড়িয়ে বসে থাকলেন। রুশ জেনারেল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন-: ‘বোধ হয় তুমি আমাকে চিনতে ভুল করেছো?’
সাঈদ বসেই উত্তর দিলেন: ‘তোমাকে চিনবো না কেন! তুমি নিকোলাস।’
রুশ জেনারেল ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো: ‘যদি তুমি জেনে-বুঝে আমাকে সম্মান প্রদর্শন না করে থাকো, তাহলে তুমি রুশীয় ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছো।’
এই কথা শুনার পর সাঈদ নির্ভীক কণ্ঠে বললেন: ‘জেনারেল নিকোলাস, কারো নিকট থেকে সম্মান পাওয়ার আশা করার আগে নিজেরও উচিত অন্যকে সম্মান করা।’
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নিকোলাস বললো: ‘মানে। তুমি কি বলতে চাও? তুমি জানো তোমার জীবন মৃত্যু এখন আমার হাতে।’
তারপর নিকোলাস একজন সিপাহিকে নির্দেশ দিলো: ‘এই একে নিয়ে যাও, এখনই ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দাও।’
সিপাহি এগিয়ে আসছে। কিন্তু সাঈদের মধ্যে কোনো ভয়-ভীতি বা ক্ষমা চাওয়ার কোন লক্ষণ নেই।
ধীর ও শান্ত গলায় সাঈদ বলল: ‘তোমার হাতে আছে বুলেট ভরা বন্দুক। তুমি সওয়ার হয়ে আছো আরবি তেজী ঘোড়ার পিঠে। তার মানে এই নয়, তুমি যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা রাখো। আর জীবন মৃত্যুর মালিক তোমার আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনি যাকে ইচ্ছে সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছে অপমানিত করেন- আমি বিশ্বাস করি, তুমি নাস্তিক নও অতএব…
নিকোলাস হাতের ইশারায় সিপাহিকে থামার আদেশ দিয়ে বললেন, ‘না ওকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারবো।’
সাঈদ বললেন, ‘আমি আমার জন্মভূমি রক্ষার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছি। আমি মজলুম। আর তুমি জালেম। জেনো রাখো মজলুমের পক্ষে আল্লাহ আর তোমার সঙ্গী শয়তান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশক্তিমান।’
কথা শেষ করে সাঈদ নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে চলে গেলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্যে।
এই দৃশ্য দেখে নিকোলাস আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আস্তে আস্তে বন্দিশিবির থেকে বের হয়ে গেলো। অপমানে, রাগে না ভয়ে বন্দিদের কেউ তা অনুমান করতে পারলেন না।