মায়ের গর্ভ থেকে জন্মের পরপরই দেখা গেল শিশু দু’টির মুখ জোড়া লাগানো (চুমু) অবস্থায় আছে। পরে চিকিৎসকরা মুখ আলাদা করে দেয়ার সাথে সাথেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল তাদের মুখে। এমন একটি জোড়া শিশুর জন্ম হয়েছে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। শিশু দু’টির নাভি, হার্ট এবং লিভার হওয়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হচ্ছে থোরাকো ওমফেলো প্যাগাস। যা অপারেশনের মাধ্যমে আলাদা করতে ঢাকায় নিতে রেফার করা হয়েছে। কিন্তু শিশু দু’টির পরিবার টাকার অভাবে নিয়ে যেতে পারছেন না ঢাকায়।
গত সোমবার বিকেলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি এবং শিশু ওয়ার্ড ঘুরে জানা গেছে, প্রসব বেদনা ওঠায় লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগর গবাই এলাকার রাজমিস্ত্রি আরিফুল ইসলামের স্ত্রী লাবনী আকতার গত ৪ অক্টোবর এই হাসপাতালে ভর্তি হন। আলট্র্রাসনোগ্রামে যমজ জোড়া লাগানো শিশু নিশ্চিত হওয়ায় বোর্ড গঠনের মাধ্যমে ৭ অক্টোবর দুপুরে করা হয় সিজার।
সিজারকারী চিকিৎসক গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা: সারমিন সুলতানা লাকী জানান, সিজারে অনেক জোড়া ও যমজ শিশু জন্মের অভিজ্ঞতা আছে আমার কিন্তু এটা একেবারেই বিরল। সিজারের পর শিশু দু’টির মুখ চুমু দেয়া অবস্থায় ছিল। আলাদা করে দিতেই হাসি দেয় তারা। মনে হয় যেন একে অপরের সাথে জড়াজড়ি করে খেলছে। শিশু দু’টি কন্যা, তাদের নাভি, লিভার এবং হার্ট একটি বলেও জানান তিনি।
এই অধ্যাপক আরো জানান, ভর্তির পরপরই আমরা কাগজপত্র দেখি। প্রসূতির বয়স ২৩ বছরের মতো হবে। এরই মধ্যে একটি বেবি সিজারে হয়েছে। সাধারণত এ সিজারের পরের বেবি আমরা ২ সপ্তাহ আগে করে থাকি। কিন্তু রোগী পরে আসায় সেই সুযোগও ছিল না। আমরা আলট্রাসনোগ্রাম করে দেখি দ্রুত সিজার করতে হবে। উন্নতভাবে চিকিৎসার জন্য শিশু বিভাগ আমাদের পরামর্শ দেয় ঢাকায় পাঠানোর। কিন্তু সময় শেষের দিকে থাকায় আমরা সেই রিস্ক নিতে পারিনি। কারণ আশঙ্কা ছিল ঢাকায় নিতে গেলে জরায়ু ফেটে যাওয়ার। সে কারণে আমরা বোর্ড গঠন করে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে সিজার শুরু করি এবং সফলভাবে সিজারের পর ওই জোড়া লাগানো যমজ শিশু জন্ম নেয়। মা এবং দু’টি শিশুই ভালো আছে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: তানভীর চৌধুরী নোমান জানান, জন্মের পরপরই শিশু দু’টিকে পাঠানো হয় হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে। আমরা আসা মাত্রই দেখি বাচ্চা দু’টি জোড়া লাগানো। জোড়া লাগানো বাচ্চার অনেক ধরন আছে। আমরা দেখতে পাই এই বাচ্চা দু’টির পেট এবং বুক এক সাথে লাগানো ছিল। এই ধরনের শিশুটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি থোরাকো ওমফেলো প্যাগাস। ওয়ার্ডে আনার কিছুক্ষণ পরে দেখি শিশু দু’টির অক্সিজেন স্যাচুয়েশন কমে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তখন আমরা অক্সিজেন দেই। যেহেতু মুখে শিশু দু’টির খাওয়া-দাওয়া করানো যাচ্ছিল না। সেহেতু আমরা আইভি দিয়ে শিশুর নিউট্রেশনটা মেইনটেইন করি। এ ছাড়াও এন্টিবায়েটিক দেয়াসহ সব ধরনের পরিচর্যা করি।
ডা: নোমান আরো বলেন, পরবর্তীতে পরিচর্যা করার সময় দুই শিশুরই পায়ে স্যাচুয়েশন করে দেখেছি অক্সিমিটার দিয়ে। তখন পায়ে এবং হার্টে স্যাচুয়েশন একই এসেছে। সেখান থেকে আমাদের মনে হয়েছে এটা কমন হার্ট শেয়ার করা। অর্থাৎ শিশু দুটো কিন্তু তাদের হার্ট এক। আবার যেহেতু তাদের পেট লাগানো সে হিসেবে তাদের লিভারও একটা। যেহেতু এ ক্ষেত্রে আলাদা করার প্রশ্ন আসবে। তখন আমরা সার্জারি বিভাগে যোগাযোগ করি। সার্জারি বিভাগের স্যাররা এসে সব দেখে শুনে আমাদের বলেছেন, আমাদের হাসপাতালে যে সেটিংস আছে, যে সুবিধাদি আছে তাতে এটা অপারেট করা পসিবল হবে না। সেই ম্যানেজমেন্ট এই হাসপাতালে নেই। তখন স্যারদের পরামর্শ নিয়ে আমরা রোববার দুপুরে শিশু দু’টিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কিংবা বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়ার জন্য ছাড়পত্র দেই।
ডা: নোমান আরো জানান, গত সোমবার সকালে আমরা শিশু দু’টির বাবার কাছে ফোন দিলে তিনি জানান, টাকা পয়সা না থাকা এবং মা গাইনি বিভাগে চিকিৎসাধীন থাকার কারণে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারেনি। শিশু বিভাগ থেকে গাইনি বিভাগে মায়ের কাছে রাখা হয়েছিল শিশু দু’টিকে। তখন আমরা আবারো শিশু দু’টিকে শিশু বিভাগে এনে চিকিৎসা করাচ্ছি। শেখ রাসেল স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিটে নিবিড় পরিচর্যায় রেখেছি। তবে যতদ্রুত সম্ভব ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ জন্য এই চিকিৎসকও ওই দম্পতির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
এ দিকে রেফার্ড করলেও ঢাকায় নিয়ে যেতে পারছে না পরিবার। অপারেশন কিংবা চিকিৎসা কোনোটাই করার সামর্থ্য নেই তাদের। এরই মধ্যে শিশুটির পিতা টাকা জোগাড় করতে না পারায় গা ঢাকা দিয়েছেন। জন্মধাত্রী মাসহ পরিবারের লোকজন চাইছেন সরকার কিংবা বিত্তবানদের সহযোগিতা।
শিশু দু’টির মা লাবনী আখতার জানান, ‘আমি আমার শিশু দুইটার জীবন বাচপার চাই। ওরা যেন ভালোভাবে বাঁচি থাকে। আমার দাবি শিশু দুইটার অপারেশনের ব্যবস্থা করি দাও। আমাদের তো টাকা-পয়সা নাই। আমার স্বামী একজন রাজমিস্ত্রি। ঢাকায় নিয়া যাওয়ার তার সামর্থ্য নাই। তাই তো হাসপাতালোত এ্যলাও আইসেই নাই। হয়তো টাকা জোগাড় করার জইন্য ঘুরি বেড়াইতেছে। এখন তোমার সাংবাদিক, তোমরা যদি বুদ্ধি করি ব্যবস্থা করি দিবার পান।’ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পৃথিবীতে এ ধরনের শিশু আলাদা না করেও বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে।