দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশে আবারো রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। পুলিশ আবারো বিরোধীদলের সভা সমাবেশ নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঢাকার নতুন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যে এমন আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় নতুন করে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায প্রকাশিত দুটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রামে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক একজন উপপরিচালক এবং বগুড়ায় একজন আইনজীবীর সহকারী পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছে। ৬৭ বছর বয়েসী অবসর প্রাপ্ত দুদক কর্মকর্তাকে যেভাবে গভীর রাতে বাসা থেকে চোর ধরার মত তুলে নেয়া হয়েছে, তাতে আমাদের পুুলিশের সাধারণ চরিত্র আবারো উঠে এসেছে। তিনি কোনো দাগি অপরাধি ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে করা সিআর মামলার ওয়ারেন্ট সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা ছিল না বলে নিহত দুদক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। গ্রেফতারের সময় অসুস্থ রোগী হিসেবে জরুরি ওষুধ ও ইনহেলার নেয়ার সময় দেয়া হয়নি। চাঁদগাঁও থানায় নিয়ে যাওয়ার পর গেট বন্ধ করে দেয়া হয় এবং অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করলে হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের অভিযোগ, প্রতিবেশীদের সাথে জমিজমা নিয়ে বিরোধের নালিশী মামলায় তাকে আটক করে নির্যাতনের পর তার মৃত্যু হয়েছে। বগুড়ার সিনিয়র আইনজীবী মঞ্জুরুল ইসলামের সহকারী ৩৬ বছরের তরতাজা যুবক হাবিবুর রহমান আদালতের গেট থেকে স্থানীয় ডিবি পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করেছে তার পরিবার। নিহত হাবিবুর বিএনপির কর্মী ছিলেন এবং বগুড়া আইনজীবীর সহকারী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পদক ছিলেন। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় থাকার কারণেই ডিবি পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে বলে হাবিবুরের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরা অভিযোগ করেছেন। তবে হাবিবুরের বিরুদ্ধে পুরনো হত্যা মামলার অভিযোগের কথা জানিয়েছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়া এবং আইনগত প্রক্রিয়ায় যে কোনো অপরাধের সুবিচার নিশ্চিত করা। একই সময়ে দেশের দুই প্রান্তে একজন অবসরপ্রাপ্ত দুদক কর্মকর্তা এবং একজন আইনজীবী সহকারীর পুলিশ ও ডিবি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের অভিযোগ শক্তিশালী করছে। বিশেষত সরকারের শেষ সময়ে এবং দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ আবারো একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরী করতে চাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জমিজমা বা স্থানীয় বিরোধের নালিশী মামলার আসামী একজন সিনিয়র সিটিজেন শহীদুল্লাহর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু কিংবা বগুড়ায় ডিবি হেফাজতে আইনজীবীর সহকারী হাবিবুরের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এক সময় রাস্তায় ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যরা অস্ত্র উদ্ধার ও আক্রান্ত হওয়ার একটি গতানুগতিক ফিরিস্তি তুলে ধরতো। সাধারণ মানুষের কাছে এসব বর্ণনা কখনো বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের সোচ্চার ভূমিকা, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর আইনশঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনা কমে আসলেও আটকের পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো খুবই উদ্বেগজনক।
আমরা লক্ষ্য করেছি, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স র্যাব ও পুলিশের ৭ শীর্ষ কর্মকর্তার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম খুনের ঘটনা কিছুটা কমে এসেছিল। র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর গুম-খুনের ঘটনাগুলোর কোনো সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া এবং মানবাধিকার সংরক্ষণে আইনগত ব্যবস্থা দৃশ্যমান না হওয়ায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞার চাপ বেড়েছে। শুধু নির্বাচনী রাজনীতির প্রশ্ন নয়, কোনো সভ্য সমাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি পুরো জাতিকে বিশ্বের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশে আইনের শাসন, মানবিক মর্যাদা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জননিরাপত্তা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের লাঠিয়ালের ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণ না হলে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন , মানবিক মর্যাদা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। গুরুপাপে লঘুদ- কাম্য নয়। হেফাজতে মৃত্যুর সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তাদের দায়িত্ব জনগণের জানমালের হেফাজত করা, হরণ করা নয়। আশা করি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি স্মরণ রেখে দায়িত্ব পালন করলে এমন অনাকাংখিত ঘটনা আর ঘটবে না।