বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যের মুখপাত্র সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে ফ্যাসিবাদী শাসন। মানুষের মর্যাদা, ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করে সরকার কর্তৃত্ববাদী কায়দায় দেশ পরিচালনা করছে।’
গতকাল রোববর (১৫ অক্টোবর) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য। এর আগে বক্তব্য রাখেন ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান। নেতৃদ্বয় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, ‘ভোটাধিকার, সন্ত্রাস-দখলদারিত্বমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী শাসন। বর্তমান সরকারের দেশ পরিচালনার কোনো রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা নেই। তাদের দখলদারিত্বমূলক শাসনে দেশ, জনগণ ও দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ বড় ধরনের বিপর্যয়ে নিপতিত হয়েছে। অধিকারবোধ ক্রমশ ক্ষমতাসীনদের কৃপা কিংবা অনুগ্রহের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। এই সরকার দেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে দিয়েছে, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান তার রাষ্ট্রীয় পরিচয় হারিয়ে দলদাসে পরিণত হয়েছে, সবকিছুকে করা হয়েছে এক ব্যক্তির ক্ষমতার অধীনস্থ। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ বিপন্ন। সার্বভৌমত্ব ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। এই সরকার জাতীয় স্বার্থকে বন্ধক রেখে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। তারা তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া।
তিনি আরো বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্ট ঘোষণা ছিল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার পতনের একদফা ও রাষ্ট্র সংস্কারে প্রস্তাবিত ৩১ দফার আলোকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তই পারে মুক্তিযুদ্ধের ওই আকাঙ্ক্ষার পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে।’
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতা এবং দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রয়োজনে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা প্রকারান্তরে গিনিপিগে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও অনুৎপাদনশীল কাঠামো অটুট থাকায় একদিকে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরদিকে শিক্ষার মান ক্রমশ নি¤œমুখী হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ মদদে প্রশ্নফাঁস শিক্ষার মূল ভিত্তিকে দূর্বল করে দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করে একদলীয় বয়ান প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে ধারণ না করে বিভক্তি ও বিভেদ সৃষ্টির নানা উপাদানে পরিপূর্ণ করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের যেকোনো দুঃসময়ে এদেশের শিক্ষার্থীরা সবার আগে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী চরিত্রকে দমনে সরকারদলীয় সংগঠন ছাত্রলীগকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের একচেটিয়া আধিপত্য জারি রাখতে যা খুশি তাই করার লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়েছে। জবাবদিহিতাহীন বেপোরোয়া ক্ষমতা ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী-দখলবাজ শক্তিতে পরিণত করেছে। ছাত্রলীগের কাঠামোগত নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক পরিসর ধ্বংস হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলোতে গণরুম-গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতন অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার জন্য বুয়েট শিক্ষার্থী আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, গেস্টরুমে নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লা। ক্যাম্পাসে বিরোধীমতের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণরুম-গেস্টরুমে নির্যাতনের পাশাপাশি গত ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনামলে নিপীড়নের সাংগঠনিক কাঠামোকে ক্লাসরুম পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে। আর সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এইসব নিপীড়নের ঘটনায় সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করেছে। সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর অবস্থা আরো শোচনীয়। ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আজ জিম্মি। তারা লড়াইয়ের শক্তি হারাতে বসেছে। রাষ্ট্র ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ যেন শিক্ষার্থীদের স্বাধীন বিকাশের পথে বাধা না হতে পারে এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যমান ছাত্র রাজনীতির কাঠামোর মধ্যেও প্রয়োজন নতুন গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত। যে বন্দোবস্ত সকল রাজনৈতিক দলের শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করবে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণে গবেষণা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সকল বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার পথকে প্রশস্ত করবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান সরকারের কাছে ছাত্র সমাজ কিংবা দেশবাসীর পদত্যাগ ভিন্ন অন্য কোনো দাবি নেই। আমাদের দাবি, গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্বাসী আন্দোলনরত সকল রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি। সরকারের পদত্যাগ, ভোটাধিকার এবং রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লড়াই তাই আজ এক সূতায় গাঁথা। বাংলাদেশকে রক্ষায় ছাত্র আন্দোলনের যে গৌরবজ্জ্বল ঐতিহ্য তা ৫২ বছরের নানান রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও নীতির কারণে আজ বিভ্রান্ত, অসংগঠিত ও পথভ্রষ্ট। একই সাথে ভয় ও দখলমুক্ত গণতান্ত্রিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামিয়ে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করা আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যেই ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে ভোটাধিকার, সন্ত্রাস-দখলদারিত্বমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে নয়দফা প্রস্তাবনা ঘোষণা করা হয়েছে। ১২ অক্টোবর ছাত্র কনভেনশনে ছাত্র ঐক্যের মুখপাত্রের পঠিত এই নয়দফা প্রস্তাবনা সারাদেশের ছাত্র প্রতিনিধিদের কাছে গৃহীত হয়েছে। এই নয়দফার ভিত্তিতে বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ক্রিয়াশীল গণতান্ত্রিক ১৫টি ছাত্র সংগঠন সম্মিলিতভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে আমাদের প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা করছি।’
কর্মসূচি: তিনি বলেন, ‘আগামী ১৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে অতি দ্রুত রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে জনমত সংগঠিত করা হবে। এভাবেই গণতান্ত্রিক, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারভিত্তিক বাংলাদেশের পক্ষে শক্তিশালী জনমত গঠন এবং রাজপথে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদীদের পতন নিশ্চিত করা হবে, ইনশাআল্লাহ। এই লড়াইয়ে আপনাদের সকলকে আমরা পাশে চাই। আপনাদের সহযোগিতা চাই। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে অচিরেই দেশের ভাগ্যাকাশে নতুন ভোরের তেজোদীপ্ত সূর্য উদিত হবে, ইনশাআল্লাহ।’
ছাত্র ঐক্যের সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সহ-সভাপতি তবিবুর রহমান সাগর, রিয়াদ ইকবাল, নাছির উদ্দিন নাছির, সাখাওয়াত হোসাইন, সাইফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মাকসুদুর রহমান সুমিত, জুয়েল মৃধা, আবু জাফর, শাজাহান শাওন, মঞ্জুরুল রিয়াদ, সালেহ মোহাম্মদ আদনান, জকির উদ্দিন আবির, সহ সাধারণ সম্পাদক রেজোয়ান আহমেদ সহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।