বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অর্থবহ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। তাদের পাঁচ দফা সুপারিশে সংলাপকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে একটি অর্থবহ সংলাপের পরিবেশ আছে কী না। আর না থাকলে তার জন্য কী করা দরকার?
চলতি মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা সফর করে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) একটি যৌথ প্রতিনিধিদল। তারা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরছেন। তার প্রথমটিই হলো একটি অর্থবহ সংলাপ এবং পাশাপাশি রাজনীতির ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন। দ্বিতীয় সুপারিশে তারা নির্বাচনের সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে অনুরোধ করেছে। সেই সঙ্গে নাগরিকদের ভিন্ন মতকেও সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। তৃতীয়ত, অহিংসার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।চতুর্থত, সব রাজনৈতিক দলকে অর্থবহ ও সমান রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে বলা হয়েছে, যেন তা স্বাধীন নির্বাচন পরিচালনার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে। সবশেষে নাগরিকেরা যেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি অর্থবহ সংলাপ ওই পাঁচটি শর্তই পূরণ করতে পারে। কিন্তু অর্থবহ সংলাপের জন্য যে পরিবেশ দরকার তা এখন নেই। আর সেই পরিবেশ তৈরি না হলে সংলাপ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের প্রধান দুই দলই তাদের নিজস্ব এক দফা নিয়ে অনড় অবস্থানে আছে। বিএনপি চায় শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর শাসক দল চায় শেখ হাসিনার অধীনে এখন সংবিধানে যে ব্যবস্থা আছে তার অধীনে নির্বাচন। কিন্তু শর্তহীন সংলাপ না হলে সেই সংলাপে কোনো ফল আসবেনা বলে মত বিশ্লেষকদের।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “দুই দলই এখন এক দফায় আছে। বিএনপি চায় তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ চায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন। দুই দল যদি এভাবে দুই প্রান্তে অনড় থাকে তাহলে তো কোনো অর্থবহ সংলাপ করা সম্ভব নয়। যদি সংলাপ হয়ও তা কোনো ফল বয়ে আনবেনা। দুই পক্ষ যদি তাদের এই অনড় অবস্থান ছেড়ে দিয়ে বিকল্প কিছু বের করতে পারে তাহলে অর্থবহ সংলাপ সম্ভব। আর এটা হলে বাকি যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো সমাধান করা সম্ভব।”
তার কথা, “বিএনপির জন্য একটি বড় ইস্যু হবে মামলা। শীর্ষ পর্যায়ে যারা মামলায় দ-প্রাপ্ত হয়েছেন তারা যদি দ- মওকুফ না পান তাহলে ওই পর্যায়ের অনেকেই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। আবার তৃণমূলের মামলা প্রত্যাহার না হলে বিএনপি নির্বাচনে এজেন্ট দিতে পারবে না। এ ধরনের অনেক সংকট আছে বিএনপির। এর সমাধানও হয়তো তারা চাইবে। আর এইসব বিষয় বাদ দিয়ে বিএনপি সংলাপে আসবে কী না আমি জানি না।”
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “তারা যে অর্থবহ সংলাপের কথা বলেছেন, তার মানে আমি মনে করি শর্তহীন সংলাপ। যেখানে কোনো পূর্ব শর্ত থাকবে না, খোলা মনে আলোচনা হবে এবং উদ্দেশ্য হবে মহৎ, রাজনৈতিক অচলবস্থার নিরসন। জনগণের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে পুলুরাল সেইফগার্ড চিন্তা করে সেটা করতে হবে।” তার মতে, “এখন রাজনৈতিক অচলবস্থা একটি জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা এবং গ্যারান্টি প্রয়োজন। তা না হলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় ন।।”
গ্যারান্টির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “গ্যারান্টি মানে হলো রিজেনবল আন্ডারস্ট্যান্ডিং, লাস্টিং এবং সেটা বাইন্ডিং। দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। অনড় অবস্থানে থাকলেতো আর সমঝোতা হয়না।”
সংলাপের পরিবেশ নিয়ে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সংলাপের জন্য মধ্যবর্তী অবস্থা দেখছিনা। দুই পক্ষই তাল গাছ আমার বলে অনড় অবস্থান নিয়ে বসে আছে। শাসক দল সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কথা বলছে আর বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইছে।” তার কথা, “এই পরিস্থিতিতে যদি অর্থবহ সংলাপ না হয় তাহলে দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাবে। লেজিমেটিসির সংকট কাটবেনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি সহিংসতার দিকে মোড় নিতে পারে।” এদিকে, সংলাপের ব্যাপারে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আগের অবস্থানেই আছে। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানের বাইরে কোনো বিষয় নিয়ে সংলাপ হবেনা। আর বিএনপি বলছে, সংলাপ হতে হবে এই সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, “এই সরকার সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অর্থবহ সংলাপের কোনো পরিবেশ রাখেনি। গতকালও (শনিবার) তারা বলেছে যেকোনো প্রকারের একটা নির্বাচন তারা করবে। আর সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো জনগণের অংশগ্রহণ।”
তিনি বলেন, “আমরা বারবার বলেছি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা এই সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের জন্য সংলাপ চাই। সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংলাপ হলে সেটা অর্থবহ সংলাপ হবে। কিন্তু সরকার সেটাকে পাত্তা দিচ্ছেনা। আমাদের আন্দোলনকে পাত্তা দিচ্ছেনা। সরকারই চায়না অর্থবহ সংলাপ হোক কারণ তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না।”
এর জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, “আমরা আগেও বলেছি, আবারও বলছি সংবিধানের অধীনে যে কোনো বিষয় নিয়ে সংলাপ করা যেতে পারে। আমরা যেকোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সংবিধানের মধ্যে থেকে কথা বলতে পারি। সংবিধানের বাইরে কোনো বিষয় নিয়ে কথা হবে না।” তার কথা, “সংবিধানের অধীনে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা হতে পারে। তারা যদি নির্বাচনে আসে তাহলে এই সরকারের অধীনে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন আরো ভালো করার জন্য কোনো সাজেশন থাকলে সেটা নিয়ে কথা হতে পারে। তবে বিএনপি যে বলছে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা বা সংলাপ হবে না।”-ডয়চে ভেলে
এনডিআই, আইআরআই এর বাংলাদেশের দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রস্তাব: বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসনে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন প্রতিনিধিদল। দেশে ফেরার পর শনিবার দেয়া এক বিবৃতিতে, প্রতিনিধি দলটি প্রস্তাবিত সংলাপকে তাদের পাঁচ দফা সুপারিশের এক নম্বর পূর্ব-শর্ত হিসাবে প্রস্তাব করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলার পর তারা তাদের সুপারিশের খসড়া তৈরি করে।
ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই)’র যৌথ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মূল্যায়নের লক্ষে ৮ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে।
প্রতিনিধিদলের সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে- সৌহার্দ্যপূর্ণ বক্তৃতা-বিবৃতি এবং মুখ্য নির্বাচনী ইস্যুতে উন্মুক্ত ও মূল সংলাপে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা এবং একটি উন্মুক্ত নাগরিক স্পেস নিশ্চিত করা, অহিংসার প্রতি অঙ্গীকার, রাজনৈতিক সহিংসতার অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা, সমস্ত পক্ষের অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সম্পৃক্ত হতে পারার পরিস্থিতি তৈরি করা এবং নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় নির্বাচনী অংশগ্রহণের সংস্কৃতি উৎসাহিত করা।
মার্কিন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন (ইসি), বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বিবৃতিতে, প্রতিনিধি দলটি পর্যবেক্ষণ করেছে যে বাংলাদেশের আদর্শিক বহুত্ববাদ, বলিষ্ঠ গণমাধ্যম, সক্রিয় নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত নাগরিক সমাজের সমর্থনপুষ্ট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের একটি সুদৃঢ় ঐতিহ্য রয়েছে। এতে বলা হয়, বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস ও পরিবেশগত নেতৃত্বে সাফল্য দেখিয়েছে। এই অর্জনগুলো ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার রূপকল্প অর্জনে একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী প্রেক্ষাপট সম্পর্কে প্রতিনিধি দলটি পর্যবেক্ষণ করে যে নির্বাচনী সহিংসতা ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে একটি সাধারণ সমস্যা। বিবৃতিতে প্রতিনিধি দল বলেছে, ‘রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা হ্রাস এই অগ্রগতির ওপর ছায়াপাত করে এবং অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের গতিপথকে দুর্বল করার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।’ প্রতিনিধি দল স্বীকার করেছে যে বাংলাদেশের জনগণই চূড়ান্তভাবে তাদের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বৈধতা এবং তাদের দেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন নির্ধারণ করবে। ‘প্রাক-নির্বাচন বিবৃতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা ও শক্তিশালী করার চেতনায় দেওয়া হয়েছে’ বলে প্রতিনিধি দলটি জানায়।