সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৭ পূর্বাহ্ন

তিলাওয়াতে দ্রুততা পরিহার করি

হুমায়ুন কবীর
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩

কুরআন মাজিদ আল্লাহ তায়ালার কালাম। কুরআন তিলাওয়াত করলে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া যায় এবং পুণ্য অর্জন করা যায়। আমরা সেই আশায় আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করি। কিন্তু তিলাওয়াতের মধ্যে আমাদের কিছু ত্রুটির কারণে তিলাওয়াত করে আমরা সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ করে ফেলি। তার অন্যতম একটি কারণ হলো- আমরা কুরআন খুব দ্রুত তিলাওয়াত করি। দ্রুততার কারণে মাঝে মধ্যে আমাদের উচ্চারণগুলো সুন্দর হয় না, অক্ষর ও শব্দের উচ্চারণ অশুদ্ধ হয়ে যায়, কখনো অস্পষ্ট হয়ে যায়, যা মোটেই উচিত নয়। কুরআন কিভাবে তিলাওয়াত করতে হবে, তার নির্দেশনা আল্লাহ কুরআনের মধ্যেই বলে দিয়েছেন। রাসূল সা:-এর জীবনে সেই তিলাওয়াতের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। রাসূল সা:-কে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘কুরআন তিলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে, সুস্পষ্টভাবে।’ (সূরা মুজাম্মিল-০৪)
আনাস রা:-কে রাসূলুল্লাহ সা:-এর তিলাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, নবীজী সা: শব্দগুলোকে টেনে টেনে পড়তেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে বললেন যে, তিনি আল্লাহ, রহমান ও রহিম শব্দকে টেনে পড়তেন।’ (বুখারি-৫০৪৬) উম্মে সালামা রা:-কেও একই প্রশ্ন করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন, নবীজী সা: প্রতিটি আয়াত আলাদা করে পড়তেন এবং প্রতি আয়াত পরে থামতেন। তিনি আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন বলে থামতেন। তার পর আর রাহমানির রাহিম বলে থামতেন। তার পর মালিকি ইয়াওমিদ্দিন বলে থামতেন।’ (আবু দাউদ-১৪৬৬, সুনানে তিরমিজি-২৯২৭)
যারা খুব দ্রুত তিলাওয়াত করে, তাদের এ ব্যাপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। দ্রুত তিলাওয়াত করতে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমরা কুরআন তিলাওয়াত করছিলাম এমন সময় রাসূল সা: এলেন। তখন আমাদের সাথে কিছু গ্রাম্য মানুষ ছিল, কিছু অনারব মানুষও ছিল। রাসূল সা: বললেন, ‘তোমরা কুরআন পড়ো, তোমরা প্রত্যেকেই উত্তম মানুষ। আর অচিরেই এমন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যারা কুরআনকে সোজা করবে, যেভাবে তীর সোজা করা হয়। (তারা তাজবিদ নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করবে) আর তারা কুরআন পাঠে খুব তাড়াহুড়া করবে, অপেক্ষা করে আস্তে ধীরে তিলাওয়াত করবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ-৮৩০) প্রায় একই ধরনের হাদিস সাহাবি হজরত সাহাল রা: থেকেও বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আমরা কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করছিলাম এমন সময় রাসূল সা: এলেন। তিনি বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর কিতাব একটিই। আর তোমাদের কেউ লাল, কেউ সাদা আবার কেউ কালো। (তোমরা ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ ও ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ) তোমরা ওই সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের আগে কুরআন পড়ো, যারা কুরআন সোজা করবে যেভাবে তীর সোজা করা হয়। আর তারা কুরআন পাঠে খুব তাড়াহুড়া করবে, অপেক্ষা করে আস্তে ধীরে তিলাওয়াত করবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ-৮৩১)
আমরা কুরআন মাজিদ দ্রুত তিলাওয়াত করি। অন্যান্য কিছু আমলও খুব দ্রুত করার চেষ্টা করি। আমরা মনে করি, দ্রুত তিলাওয়াত করে যত বেশি পড়তে পারব, তাড়াহুড়ো করে যত বেশি আমল করতে পারব, তত বেশি সওয়াবের অধিকারী হতে পারব এবং কিয়ামতের দিন বেশি হওয়াটা আমাদের জন্য লাভজনক হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, কিয়ামতের দিন আমাদের আমল গণনা করা হবে না যে, কে কত পারা তিলাওয়াত করল, কত খতম শেষ করল বা কত রাকাত নামাজ পড়ল; এসব দেখা হবে না; বরং মিজানের পাল্লায় আমাদের আমলগুলো পরিমাপ করা হবে। ওজন করা হবে। যেমন- কুরআন মাজিদে আল্লাহ বলেছেন- ‘কিয়ামতের দিন সঠিকভাবে আমলগুলো ওজন করা হবে, সুতরাং যাদের পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম ও কৃতকার্য হবে।’ (সূরা আরাফ-০৮) এ জন্য তাড়াহুড়ো করে আমলের সংখ্যা না বাড়িয়ে আস্তে ধীরে আমল করে আমলের গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘যার পাল্লাগুলো ভারী হবে, সে সন্তোষজনক জীবনে থাকবে।’ (সূরা কারিয়াহ : ৬-৭)
আমাদের আমলগুলোর সংখ্যা বাড়ানো বেশি প্রয়োজন নাকি ওজন বাড়ানো বেশি করা প্রয়োজন, এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ: অনেক সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমলের ওজন ইখলাস তথা আন্তরিকতা ও সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্যতার কারণে বেড়ে যায়। যার আমল আন্তরিকতাপূর্ণ ও সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সংখ্যায় কম হলেও তার আমলের ওজন বেশি হবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি সংখ্যায় অনেক আমল করবে, নামাজ, রোজা, দান-সদকা, হজ-ওমরাহ অনেক করবে, কিন্তু আন্তরিকতা ও সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্য কম হবে, তার আমলের ওজনও কম হবে। মানুষ আমলের যে পুঁজি নিয়ে আল্লাহর আদালতে আসবে তা ভারী না হালকা, তার ভিত্তিতে সেখানে ফয়সালা অনুষ্ঠিত হবে। (মাজমুল ফাতাওয়া লিশাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ : ১০/৭৩৫-৭৩৬) সুতরাং কুরআন তিলাওয়াতসহ সব ধরনের আমলের ব্যাপারে আমাদের আন্তরিক হতে হবে। আল্লাহর নির্দেশনা ও রাসূল সা:-এর সুন্নাত অনুযায়ী আমল করতে হবে। ইমাম গাজ্জালি রহ: বলেছেন, ‘অনেক মানুষ এমন রয়েছে, তারা কুরআন তিলাওয়াত করে কিন্তু কুরআন তাদেরকে অভিশাপ দিতে থাকে।’ (ইয়াহইয়ু উলুমিদ্দিন-১/৩২৪) এর ব্যাখ্যায় অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, যারা দ্রুত তিলাওয়াত করে, অক্ষরগুলো স্পষ্টভাবে পড়ে না, উচ্চারণ সুন্দর করে না কুরআন তাদেরকে অভিশাপ দেয়। আমরা কুরআনের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি চায় সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বেশি ভালোবাসুক এবং বেশি ভালোবাসা পাক, সে যেন কুরআন দেখে তিলাওয়াত করে।’ (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান-২২১৯) আরেক হাদিসে হজরত আবু উমামাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কুরআন পাঠ করো। কেননা কিয়ামতের দিন কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আগমন করবে।’ (মুসলিম-১৯১)
সুতরাং আমাদের জন্য উচিত হবে, আমরা এমনভাবে কুরআন তিলাওয়াত করব, যে তিলাওয়াত আমাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নৈকট্য লাভের মাধ্যম হবে। ভালোবাসা পাওয়ার উপায় হবে। মিজানের পাল্লা ভারী হওয়ার মাধ্যম হবে। যে তিলাওয়াত আমাদের জন্য সুপারিশকারী হবে। আমাদের তিলাওয়াত আমাদের জন্য অভিশাপ না হোক।
লেখক : শিক্ষার্থী, দাওরায়ে হাদিস, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া, আরজাবাদ মাদরাসা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com