সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল এক মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। গাজায় সশস্ত্র প্রতিরোধগোষ্ঠী হামাস ৭৫ বছর ধরে তাদের চৌদ্দপুরুষের বাড়িঘর হারানোর বেদনা, নির্বিচারে হাজার হাজার নারী-শিশু হত্যা, ছয় হাজারেরও বেশি নিরীহ ফিলিস্তিনিকে কারাগারে নিক্ষেপ এবং পবিত্র মসজিদুল আকসাকে অপবিত্র করার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে আচমকা অভিযান ‘অপারেশন আল-আকসা তুফান’ পরিচালনা করে। তারা এক হাজার ৪০০ সামরিক-বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে আসে। এর জবাবে ইসরাইলি বাহিনী ৭ অক্টোবর থেকে বিরতিহীনভাবে গাজায় বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে এসে ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলকে গাজায় জাতিগত নিধনে সম্পূর্ণ নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, আরবসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনিদের শুধুই ‘লিপ সার্ভিস’ দিচ্ছে। এটি সত্যিই ৫৭টি মুসলিম দেশের প্রায় ২০০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও বেদনার বিষয়। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব এখানে চরম স্বার্থপরতা ও লজ্জাকর ভীরুতার পরিচয় দিয়েছে!
গত ৩৯ দিনের ইসরাইলি বাহিনীর সন্ত্রাসী আক্রমণে উত্তর গাজা মাটির সাথে মিশে গেছে। এটি কোনো যুদ্ধ নয়। যুদ্ধ হয় দু’টি সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে। কিন্তু এখানে ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর গাজায় নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে। এটি সন্ত্রাসী হামলা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস! এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার নিরস্ত্র মানুষ তারা হত্যা করেছে। এর মধ্যে চার হাজারেরও বেশি শিশু ও প্রায় দুই হাজার মহিলা রয়েছে। অসংখ্য নবজাতকও রয়েছে নিহতদের মধ্যে। ইসরাইল অনবরত বিমান হামলা চালাচ্ছে গাজার বাড়িঘর, হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাম্বুলেন্স এমনকি বাড়িঘর ছেড়ে পলায়নরত মানুষগুলোর উপর। তারা উত্তর গাজার ১০ লাখ মানুষকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর নির্দেশনা দিয়ে সেই পলায়নরত মানুষগুলোর উপর বোমা হামলা চালিয়েছে। আল-আহলি হাসপাতালে বোমা মেরে রোগীসহ একসাথে ৫০০ মানুষকে হত্যা করেছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞকে যুদ্ধাপরাধ বলে সংজ্ঞায়িত করেছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা বলেছেন, ‘আমার ৭৮ বছরের জীবনে অনেক নৃশংসতা দেখেছি। কিন্তু গাজার মতো এত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ আর কখনো দেখিনি।’ গাজায় এখন লাশ দাফনেরও জায়গা নেই। ফুটবল মাঠ ও ফলবাগিচায় লাশ দাফন করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘গাজা এখন শিশুদের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে’। গাজার মানুষ হাতে ব্রেসলেট পরে তাতে নাম-ঠিকানা খোদাই করে রাখছে যেন মৃত্যুর পর কমপক্ষে জীবিত আত্মীয়-স্বজন লাশ শনাক্ত করতে পারে! গাজায় ইসরাইলের চলমান জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়ায় সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ দেশে দেশে মানুষ প্রতিবাদ করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ইসরাইলকে দায়ী করছে। কোনো কোনো অমুসলিম দেশের সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে। কলম্বিয়া, বলিভিয়া, স্পেন, বেলজিয়াম ও দক্ষিণ আফ্রিকা গণহত্যার প্রতিবাদে ইসরাইলবিরোধী শক্ত অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে ইসরাইলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে পুরো বিশ্ববাসীর প্রতিবাদের মুখে মার্কিনিরা এখন গাজায় ‘ঐঁসধহরঃধৎরধহ চধঁংব’ বা ‘মানবিক যুদ্ধবিরতির’ কথা বলছে। ‘সুমধুর’ শব্দ ও বাক্য দিয়ে তারা বিশ্ববাসীকে প্রতারিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’ নয়; বরং এই মুহূর্তেই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ চায় বিশ্ববাসী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিছক নিজেদের আর্থ-ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণেই এমন অন্ধভাবে সমর্থন জানাচ্ছে ইসরাইলকে। মধ্যপ্রাচ্য তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চল। এই তেল ও গ্যাসসম্পদের ওপর প্রভাব বিস্তার অত্যন্ত জরুরি। আর ইসরাইল হলো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি চৌকি বা ‘আউটপোস্ট’। এখানে রয়েছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ ‘সুয়েজ খাল’। এই সুয়েজ খালের জলপথ নিজ বলয়ে রাখার জন্য দরকার ইসরাইলকে। কাজেই ১৯৪৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি কে ট্রুুম্যান অবৈধভাবে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে দখল করা ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় খরিদদার হলো ইসরাইল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির এক জরিপে দেখা যায়, ৫৮ শতাংশ মার্কিনি ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতিশীল। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন তৈরিতে অনেক ইহুদি সংগঠন তৎপর। ‘আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি’ (অওচঅঈ)) অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠন। এই সংগঠন প্রতি বছর ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রায় ২০ হাজার প্রতিনিধি নিয়ে সম্মেলন করে থাকে, যেখানে জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ইসরাইলপন্থী এসব গ্রুপ তিন কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার তহবিল দিয়েছে; যার ৬৩ শতাংশ পেয়েছে ডেমোক্র্যাটরা অর্থাৎ বাইডেনের দল আর ৩৬ শতাংশ পেয়েছে রিপাবলিকানরা (প্রাগুক্ত)। জানা যায়, গাজা স্ট্রিপ এবং অধিকৃত ফিলিস্তিন তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের এক বিশাল ভা-ারের ওপর ভাসছে। কাজেই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে পারলে ইসরাইল এই বিশাল তেল ও গ্যাসসম্পদে অবাধ প্রবেশাধিকার পাবে যা মার্কিন-ইসরাইল এনার্জি সহযোগিতা চুক্তির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে।
মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত হতাশাজনক। তারা শুধু ‘লিপ সার্ভিস’ দিয়েই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানরা যতটুকু প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তা করছেন কেবল দেশের নাগরিকদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে। একদিকে ভীরুতা অন্যদিকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তারা আজ গাজায় মুসলমান ভাইবোন ও শিশু-সন্তানদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। ইসরাইল নামক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রটি মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম বিশ্বের একেবারে পেটের মধ্যে অবস্থিত। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সর্বোচ্চ সামরিক শক্তিধর দেশ হওয়ার সাথে সাথে ইসরাইলের রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। মুসলিম দেশগুলো তাই ইসরাইলের সামরিক শক্তির ভয়ে হাত গুটিয়ে থাকে। তার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণেও মুসলিম দেশগুলো ভীতসন্ত্রস্ত। বিভিন্ন মুসলিম দেশের সরকার নানাভাবে আমেরিকা এবং ইসরাইলের আর্থিক সুবিধার ভাগিদার। তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে চান না। এসব সুবিধাভোগী নেতারা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। জর্দান ও মিসর ইতোমধ্যে ইসরাইলের সাথে পূর্ব-ভূমধ্যসাগরের বিশাল মজুদের তেল ও গ্যাস আহরণের জন্য বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করছে। অর্থনৈতিক স্বার্থেই বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ নামে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম দেশও এই চুক্তির আওতায় আসার পথে রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব যে সৌদি আরবের তারাও ইসরাইলের সাথে চুক্তির দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল ‘হামাস’ অভিযানের আগে। মধ্যপ্রাচ্যে এ সমস্ত কূটনৈতিক বিজয় ইসরাইল অর্জন করে চলছিল মার্কিনিদের সরাসরি মধ্যস্থতায়। আরব দেশগুলোর আরেকটি বড় ভয় হলো রাজতন্ত্রের প্রতি হুমকি। মধ্যপ্রাচ্যে ‘হামাসের’ মতো একটি বিপ্লবী গোষ্ঠী সফলতা লাভ করলে এর বিপ্লবী ঢেউ তাদের রাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রকে তছনছ করে ফেলতে পারে। ২০১১ সালের আরব বসন্তের দুঃস্বপ্ন মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদেরকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়।
ফিলিস্তিনিদের হত্যার প্রতিবাদে শক্তভাবে দাঁড়ানোর অর্থ ইসরাইল-আমেরিকার সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া নয়। সামরিক শক্তির বাইরেও মুসলিম বিশ্বের হাতে রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী ‘ঝড়ভঃ ডবধঢ়ড়হ’ বা ‘নরম অস্ত্র’। প্রথমেই তারা ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারতেন। এরপর ইসরাইলের পণ্য বর্জনের ডাক দিলে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বাজার তারা হারাতে পারে। যা হতে পারে ইসরাইলের ওপর অত্যন্ত কঠিন ও অসহনীয় চাপ। সৌদি আরবের তেলসম্পদও অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র। এই তেল অবরোধ খুবই কার্যকর হতে পারত। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ছাড়া প্রায় সব দেশেই মার্কিন সামরিক স্থাপনা রয়েছে। এই দেশগুলো ওইসব মার্কিন সামরিক স্থাপনার অবস্থান নিয়ে অবশ্যই মার্কিনিদের চাপ সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, একদিকে ইসরাইল গাজা ধ্বংস করছে, অন্যদিকে সৌদি আরব, কুয়েত, জর্দান, ইরাক, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে নতুন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে! আর সৌদি আরবে মার্কিনিরা মোতায়েন করেছে ‘টার্মিনাল হাই অলটিচুড এরিয়া ডিফেন্স’ (ঞঐঅউ) নামে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো- মুসলিম দেশগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি গাজা বিষয়ে ‘ওআইসি’ ও ‘আরব লিগ’ যৌথভাবে সম্মেলন করলেও তারা ইসরাইলের উপর চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্তে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ইরান, আলজেরিয়া ও লেবানন ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার প্রস্তাব দিলে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও আরেকটি মুসলিম দেশ সেই প্রস্তাবে ভেটো দেয়। ফলে ‘ওআইসি’ গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিশ্বনেতাদেরকে চিঠি দিয়ে লজ্জাজনকভাবে তাদের দায়িত্ব শেষ করে! লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
e-mail: maksud2648@yahoo.com