মিথ্যায় ধ্বংস। মিথ্যায় পাপ। মিথ্যায় মোনাফেক। মিথ্যায় অভিশাপ। মিথ্যা, মিথ্যুক ও মিথ্যা অভিযোগকারী এদের সবাই অভিশপ্ত ও ঘৃণিত। মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা কথার থেকেও গুরুতর অপরাধ। মিথ্যার যত রূপ হতে পারে সবি ঘৃণিত। মিথ্যা অভিযোগে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। যা ভুক্তভোগী ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। তাই যেকোনো প্রকারের মিথ্যা পরিত্যাজ্য। একটি মিথ্যা অনেক মিথ্যার রাস্তা খুলে দেয়। একটি মিথ্যাকে সত্যরূপে প্রমাণিত করতে অন্য অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। তাই এটি বাহুল্য নয় যে, মিথ্যা পাপের সোপান। যা পাপের সিঁড়িকে উন্মোচিত করে। যা চলন্ত সিঁড়ির মতো চলতেই থাকে।
মিথ্যা কথা:মিথ্যা বলা এমন একটি খারাপ স্বভাব যা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সব দুর্নীতি আর দুরাচারকে সামনে নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ সা: মিথ্যাকে যতটা ঘৃণা করতেন অন্য কিছুকে ততটা ঘৃণা করতেন না। তিনি কোনো ব্যক্তির মিথ্যা স¤পর্কে জানতে পারলে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। যদি সে তার মিথ্যার ব্যাপারে তাওবাহ করত, তাহলেই তিনি স্বাভাবিক হতেন (শুয়াবুল ঈমান : ৪৪৭৫)। মিথ্যুক যেকোনো পাপকাজ অবলীলায় করতে পারে। কোনো পাপের জন্য সে অনুতপ্ত হয় না। মু’মিন কখনো মিথ্যুক হতে পারে না। নবীজী বলেছেন, একজন মু’মিনের ভেতরে অনেক ধরনের ত্রুটিই থাকতে পারে; কিন্তু কোনোভাবেই সে মিথ্যুক ও অসৎ হতে পারে না (আহমাদ : ২২১৭০)।
সন্তান প্রতিপালনে মিথ্যা:ইসলাম স্বচ্ছ-সফেদ জীবনব্যবস্থায় বিশ্বাসী। তাই সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সততায় গুরুত্বারোপ করে। অঙ্কুরেই সততার সফেদ চাদরে মুড়িয়ে নেয়ার দীক্ষা দেয়। তাই সন্তান প্রতিপালনে মিথ্যার আশ্রয় নেয়াকে প্রশ্রয় দেয় না। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আমের বলেন, একদিন নবীজী সা: আমাদের বাড়িতে ছিলেন। এমতাবস্থায় আমার মা আমাকে ডাকলেন এবং বললেন এলে তোমাকে জিনিস দেবো। তখন নবীজী তাকে বললেন, তুমি কি আসলেই কিছু দেবে? তিনি বললেন, আমি তাকে খেজুর দেবো। তখন নবীজী বললেন, যদি তুমি তাকে সেটি না দিতে তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা লেখা হতো। (আবু দাউদ : ৪৯৯১) মিথ্যা ও ধোঁকাপূর্ণ কথায় শিশুর কচি হৃদয় প্রভাবান্বিত হয় এবং তারা এমন করাকে স্বাভাবিক মনে করতে থাকে।
ঠাট্টার ছলে মিথ্যা:ঠাট্টার ছলে মিথ্যা বলা কেমন যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নবীজী সা: সেসব স্থান ও আয়োজন পরিহার করতে বলেছেন যেখানে মিথ্যা চর্চা হয়। বর্তমান সমাজে কিছু কিছু আয়োজন এমন আছে, যেখানে মিথ্যাকে আর্ট হিসেবে পেশ করা হয়। মিথ্যাকে সুন্দর উপস্থাপনের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। আর শ্রোতারা তা নির্দ্বিধায় গলাধঃকরণ করে। যা অত্যন্ত গর্হিত এবং পরিত্যাজ্য বটে। নবীজী সা: বলেছেন, সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস যে মানুষ হাসানোর জন্য (কৌতক) মিথ্যা বলে। (তিরমিজি : ২৩১৫)
প্রশংসাচ্ছলে মিথ্যা বলা:কারো প্রশংসা করার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করাও একধরনের মিথ্যা। এমন মিথ্যা ও চাটুকারিতা থেকে বিরত থাকা উচিত। যে গুণ নিজের ভেতরে নেই সেই গুণের প্রশংসা শুনে খুশি হওয়া উচিত নয়। এমন প্রশংসায় বাধা দেয়া উচিত। নবীজী স: বলেছেন যারা প্রশংসায় অতিরঞ্জিত করে, তোমরা তাদের মুখে মাটি ছুড়ে মারো। (আবু দাউদ : ৪৮০৪)
মিথ্যা অপবাদ:অপবাদ কুরআনে বর্ণিত এক জঘন্য অপরাধের নাম। অপবাদ সাধারণ মিথ্যার থেকেও জঘন্য। এতে বান্দার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হয়। অরাজকতার সৃষ্টি হয়। মানুষ পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারায়। সম্পর্ক ছিন্ন হয়। অপবাদ প্রদানকারীকে কুরআন অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছে। এর দ্বারা ব্যক্তি অন্যের সম্মানহানির পাশাপাশি নিজেকে কবিরা গুনাহে লিপ্ত করে। যা কোনো ক্ষেত্রেই কল্যাণকর ও ফলপ্রসূ নয়। আমাদের সমাজে অপবাদের নানান ধরন প্রচলিত আছে। যেগুলো প্রত্যেকটি জঘন্য থেকে জঘন্যতর। আমাদের উচিত সেগুলো থেকে বিরত থাকা।
চারিত্রিক অপবাদ:চারিত্রিক অপবাদ একটি মারাত্মক অপরাধ। এতে ব্যক্তির সম্মানহানি করা হয়। সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। অপবাদ প্রদানকারীরা হয়তো সেটিকে হালকা মনে করেন; কিন্তু বিষয়টি আসলেই গুরুতর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না। তোমরা একে তুচ্ছ মনে করেছিলে, অথচ এটা আল্লাহর কাছে গুরুতর অপরাধ।’ (সূরা নূর : ১৫)। কোনো বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া শুধু অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলা অপরাধ ও গুনাহ। এমন ধারণাপ্রসূত কথা থেকে বিরত থাকা উচিত। কুরআনে এসেছে, ‘হে ঈমানদাররা তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাকো, নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা গুনাহ। (সূরা হুজুরাত : ১২)
চারিত্রিক অপবাদের শাস্তি: কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়া কাউকে চারিত্রিক অপবাদ দেয়া ঘৃণিত কাজ। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। মিথ্যা অপবাদের কঠিন শাস্তি আখেরাতে হবে। সাথে সাথে দুনিয়াতেও আল্লাহ তাদের জন্য শাস্তির ঘোষণা করেছেন। যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতপর স্বপক্ষে চারজন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরাই নাফরমান। (সূরা নূর : ৪)
রাজনৈতিক অপবাদ: রাজনৈতিকভাবে ব্যক্তিকে হেরেস করা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে অপবাদ আরোপ করা একটি জঘন্যতম অপরাধ, যা আমাদের সমাজে অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। রাজনীতির বিষয়াদিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা উচিত। কাউকে ঘায়েল করার জন্য মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা, চারিত্রিক কালিমা লেপন করা, স্পষ্ট অন্যায় ও জুলুম। মিথ্যা অপবাদে জেলহাজতে রাখা। জনতার সামনে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা কূটিল ও অসৎ লোকের কাজ। আখেরাতে এদের কোনো অংশ থাকবে না। এরা কেয়ামতে রিক্তহস্তে উত্থিত হবে। জুলুম, অত্যাচার এবং ব্যক্তির অধিকার হরণের অপরাধে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
মিথ্যা সাক্ষ্য:মিথ্যা সাক্ষ্য বর্তমান সমাজে ক্যান্সার ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি বিচারিক কার্যালয়েও মিথ্যা সাক্ষ্যের ছড়াছড়ি। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে রায়ও হয় এবং ব্যক্তিকে সাজা ভোগ করতে হয়। এর থেকে বড় জুলুম কী হতে পারে? যে সমাজে মিথ্যা সাক্ষ্য দেখা দেয়, সেই সমাজে ন্যায়, ইনসাফ থাকে না। হিংসা, বিদ্বেষ লেগে থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা উবে যায়। আমাদের ঠোঁট ও জবান আল্লাহর দান। আল্লাহ বলেন, (আমি তাদেরকে) জিহ্বা ও দুই ঠোঁট দিয়েছি। (সূরা বালাদ : ৯) এগুলো দিয়েছেন সত্য কথা বলতে। সত্য সাক্ষ্য দিতে। যদিও তা নিজের কিংবা পিতা-মাতার বিরুদ্ধে যায়। কুরআনে এসেছে, হে ঈমানদাররা, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটাত্মীয়ের যদি ক্ষতি হয় তবুও। (সূরা নিসা : ১৩৫)।
মিথ্যা সাক্ষ্যের কুফল:এক. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবিরাহ গুনাহ। নবীজী সা:কে কবিরাহ গুনাহ স¤পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা। পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। হত্যা করা। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। (বুখারি : ৬৯১৯)। দুই. শিরকের সমতুল্য অপরাধ। সাহাবি ইবনে মাসউদ রা: মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরকের সাথে তুলনা করে, সূরা হজের ৩০-৩১ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করেন। অতএব তোমরা বিরত থাক মূর্তির নাপাকি থেকে এবং বিরত থাক মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া থেকে, আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে তার সাথে শিরক করা ব্যতীত। তিন. মিথ্যা সাক্ষ্য জুলুম। জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। নবীজী সা: বলেছেন, অত্যাচারী ব্যক্তি কেয়ামতের দিন অন্ধকারে থাকবে। (মুসলিম : ২৫৭৮)। চার. মিথ্যা সাক্ষ্যে অন্যের অধিকার নষ্ট হয়। যেই ব্যক্তির অধিকার নষ্ট করা হবে, কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া আল্লাহও অপরাধীকে ক্ষমা করবেন না। পাঁচ. সর্বোপরি মিথ্যা সাক্ষীর কারণে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। যার থেকে বড় দুঃখ ও কষ্টের কিছু হতে পারে না।
মিথ্যা অভিযোগ:মিথ্যা অভিযোগে কারো ক্ষতি সাধন করা, নিজের পায়ে নিজে কুঠারাঘাত করার মতো। এতে ব্যক্তির আখেরাত ধ্বংস হয়। মিথ্যা মামলা বা অভিযোগে কাউকে শাস্তির মুখোমুখি করায় সেই ব্যক্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এর দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি দুনিয়ায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইজ্জত-আবরু নষ্ট হয়। যার ক্ষত চিরকাল থেকে যায়। ভুক্তভুগী ব্যক্তি সারা জীবন সেই ক্ষত বয়ে বেড়ায়। আর মিথ্যা অভিযোগ আরোপকারী ব্যক্তিকে জাহান্নামে কঠিন আজাব আস্বাদনের মাধ্যমে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদরাসা, রংপুর