বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৬ অপরাহ্ন

হেনরি কিসিঞ্জার কেন চীনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরনো বন্ধু ছিলেন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩
ছবির ক্যাপশান: ২০১৮ সালে বেইজিং হেনরি কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের মৃত্যুর ঘটনায় প্রশংসা আর স্মৃতিচারণে ভাসছে চীন, যদিও দেশ দুটির মধ্যে পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক বিরাজ করছে। “আপনি সবসময় চীনের জনগণের বন্ধু, শান্তিতে ঘুমান,” এটি চীনের সামাজিক মাধ্যম ওয়েবুতে সবচেয়ে বেশী লাইক পাওয়া কমেন্ট। মি. কিসিঞ্জারের মৃত্যুর খবরটি আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ সম্পর্কিত হ্যাশট্যাগ সবচেয়ে বেশি সার্চ হয় চীনে যা লাখ লাখ মানুষ দেখেছে। “এটি একটি যুগের অবসান,” শীর্ষ লাইক পাওয়া কমেন্টগুলোর একটি। আরেকজন লিখেছেন, “তিনি কয়েক দশকের উত্থান পতনের সাক্ষী। এখনকার চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে তিনি কি ভাবতেন,” আরেকজন মন্তব্য করেন।
মি. কিসিঞ্জারের চেষ্টায় ১৯৭৯ সালে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে আলোচনা শুরুর আগে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলো। যদিও সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছিলো প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সময়ে। তবে তার আগে রিচার্ড নিক্সন ছিলেন প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ১৯৭২ সালে বেইজিংয়ে তার ঐতিহাসিক সফরে গিয়ে মাও জেদং এর সাথে সাক্ষাত করেন। এটি কয়েক দশকের উত্তেজনার অবসান ঘটায়। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে মি. কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য দাঁড় করান। আর এটিই পশ্চিমের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে চীনের সিদ্ধান্ত নেয়াকে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে তিনি নিজেই বেইজিং যান মি. নিক্সনের বৈঠকের ব্যবস্থা করতে। চীনের সামাজিক মাধ্যমে মি. কিসিঞ্জারকে নিয়ে যেসব কমেন্ট এসেছে তার বেশিরভাগেই তাকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সুন্দর করার সময় থেকে একজন পুরনো ও বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবেই সম্মান ও মর্যাদার সাথে তুলে ধরা হয়েছে। ওই সময়টিতে আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথেও আলোচনার চেষ্টা করছিলো এবং আশা করছিলো যে চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক উত্তেজনা কমাতে ভূমিকা রাখবে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখনো চরম পর্যায়ে। মি. কিসিঞ্জার একইসাথে শান্তি চুক্তির জন্য প্রশংসিত আবার দ্রুত যুদ্ধ শেষ না করার জন্য সমালোচিত।
তাকে যুদ্ধাপরাধীও বলা হয়
লাওস ও কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণে ভূমিকার জন্য তাকে যুদ্ধাপরাধীও বলা হয়। লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ তখন নিহত হয়েছিলো। ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া অপছন্দনীয় হলেও যুক্তরাষ্ট্র-চীন সুসম্পর্কের সূচনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই চীনে বড় করেই দেখা হয়। চীনের মানুষের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশী পরিচিত আমেরিকান।
দেশজুড়ে এখন ইতিহাসের ক্লাসেও তার নাম বলা হয় এবং অনেকেই তাকে দেখেন বন্ধুভাবাপন্ন পশ্চিমা হিসেবে।
তার কয়েক দশকের ক্যারিয়ারে চীনের সাথে মি. কিসিঞ্জারের বিভিন্ন বিষয়ে যে সংশ্লিষ্টতা সেটিই তাকে মনে রাখার মতো কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। “চীন হলো সেই দেশ যার সাথে আমার দীর্ঘ সময়ের এবং গভীর যোগাযোগ আছে। চীন আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে,” তিনি ২০১১ সালে চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়ার সাথে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন। বিদেশী অল্প কয়েকজন নেতার মধ্যে তিনি একজন যিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পাঁচটি প্রজন্ম অর্থাৎ মাও থেকে শি জিনপিং এর সাথে কাজ করেছেন। ওয়েবুতে এক পোস্টে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন সিসিটিভি তাকে উল্লেখ করেছে ‘লিভিং ফসিল’ হিসেবে যিনি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সমর্থন ছিলো দারুণ শক্তিশালী। তিনি ১৯৮৯ সালে তিয়েনমান স্কোয়ারে ছাত্র বিক্ষোভে নৃশংস দমন অভিযানকে ‘অনিবার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে এক লেখায় তিনি লিখেছিলেন, “এই নৃশংসতা ছিলো দুঃখজনক”। কিন্তু তিনিই আবার সেখানে লিখেছিলেন “দুনিয়ার কোন সরকারই তার রাজধানীর একটি প্রধান চত্বর আট সপ্তাহ ধরে লাখ লাখ বিক্ষোভকারীদের দখল করে রাখাকে মেনে নিবে না”। তিনি লিখেছেন “দু’দেশের সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার এমন ইস্যুতে চীন আমেরিকার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ”।
১০০ বারের বেশি চীন সফর: সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও মি. কিসিঞ্জারকে বারবার ডাকা হয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে। তিনি এটা করে গেছেন সারা জীবন ধরেই- এমনকি যখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও আমেরিকার ক্ষমতার অন্যতম চ্যালেঞ্জার হয়ে গেছে তখনও। তাকে সবসময়ই বেইজিংয়ে স্বাগত জানানো হয়েছে। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্ক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি একশবারের বেশি চীন সফর করেছেন। অবসরের অনেক পরে তিনি শেষ সফর করেছেন গত জুলাইয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তেজনা বিরাজ করা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
মি. শি তাকে বলেছেন যে চীন কখনো ‘আমাদের পুরনো বন্ধুকে’ ভুলবে না। দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই বলেছেন চীনা নীতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার ‘কিসিঞ্জার স্টাইল কূটনৈতিক প্রজ্ঞার’। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের গুরুত্বপূর্ণ সফরের সময় মি. কিসিঞ্জারের সফরে হোয়াইট কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলো। মনে হচ্ছিলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মকর্তাদের চেয়ে মি. কিসিঞ্জারের উপস্থিতিই বেইজিংয়ের কাছে বেশি পছন্দের। “চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ডঃ কিসিঞ্জারের কৌশলগত ভিশন, রাজনৈতিক সাহস ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া,” চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছেন। এ সময় তিনি মি. কিসিঞ্জারকে ‘চীনা জনগণের পুরনো ও ভালো বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টিও মি. কিসিঞ্জারের প্রশংসা করার ক্ষেত্রে বেশ দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। যদিও আমেরিকার প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত সেটি। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রাষ্ট্রদূত শিয়ে ফেং বলেছেন, “শতবর্ষী মানুষটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছে তা ইতিহাস মনে রাখবে”।
চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়া চীনা নিউজ সার্ভিস বলেছে মি. কিসিঞ্জার ছিলেন তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টির মানুষ যার মধ্য দিয়ে তিনি বৈশ্বিক বিষয়াবলী দেখতেন। ১৯৭৯ সালে যখন চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় তখন যুক্তরাষ্ট্র স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়ার চিন্তা থেকে সরে আসে এবং ‘এক চীন’ নীতিতে সম্মতি দেয়, যার সরকার বেইজিং থেকে পরিচালিত হয়। “ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি ছিলেন নেতিবাচক একটি চরিত্র,” একজন লিখেছেন ফেসবুকে। আরেকটি বহুল পঠিত কমেন্ট হলো: “তিনি তাইওয়ানকে অনেক বেশি ভুগিয়েছেন”।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com