জবাবদিহিমূলক, গণতান্ত্রিক, সুশাসিত ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে জাতীয় সংসদের প্রত্যাশিত কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরীভূত হতে যাচ্ছে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সদস্যরা। টিআইবির সাথে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪৫ জন সদস্যদের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণ করেন (সদস্যগণ টিআইবির সাধারণ পর্ষদ বা General Assembly-এর সদস্য নয়)। সভায় সদস্যরা দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ, দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা হ্রাস, হয়রানি, হামলা ও মামলার মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধসহ স্বাধীন মত ও চিন্তা প্রকাশের চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন টিআইবির সদস্যরা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবির সাধারণ পর্ষদে সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রফেসর ড. প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল হক। সভায় উপস্থাপিত সদস্যগণ টিআইবি পরিচালিত গবেষণা, অধিপরামর্শমূলক ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক হিসাবের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য এবং সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
সভা শেষে এক ঘোষণাপত্রে বলা হয়, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও জনসাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে এমন প্রত্যাশা ছিল। তবে তফসিল ঘোষণার আগে ও পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বুঝায়-তা এবারও হবে না, যা চরম হতাশাজনক। জনগণের ভোটের অবাধ অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে দেশে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে মত দেন সদস্যরা। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার, প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ভূমিকা নিশ্চিতে জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের আহ্বান জানান সদস্যরা।
ঘোষণাপত্রে আরো বলা হয়, সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতিতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করায়, দেশের গৌরবময় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ম্লান করে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রয়োগ ব্যাহত হচ্ছে এবং দুর্নীতি মহামারির রূপ নিয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত অর্থ পাচার ও ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি এতটাই প্রকট যে, প্রতিবছর নতুন রেকর্ডের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ঘটনা রোধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না উল্টো দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে।
দুর্নীতির এ জাতীয় সর্বগ্রাসী ভয়াল গ্রাস থেকে পরিত্রাণ পেতে সকল প্রকার করুণা, অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে পরিচয় ও অবস্থান নির্বিশেষে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সকলের কার্যকর জবাবদিহিতা নিশ্চিতের আহ্বান জানান সদস্যরা। যে সুনির্দিষ্ট অভীষ্ট নিয়ে দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, একাধিক আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দুদকের ক্ষমতা হ্রাস করে তা অর্জনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়েছে বলে গভীর হতাশা প্রকাশ করেন টিআইবির সদস্যবৃন্দ। সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট ২০১৮, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২, আয়কর আইন ২০২৩-এর যে সকল ধারা দুদকের ক্ষমতাকে খর্ব করেছে, তা অবিলম্বে সংশোধন করার জোর দাবি জানান তারা।
টিআইবির সদস্যগণ মনে করেন, সরকারের দায়িত্ব হলো অর্পিত ভূমিকা পালনে গণমাধ্যম যেন বাধার মুখে না পড়ে এমন উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সময়ে দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যাগত তথ্য উপস্থাপন করে অন্তসারশূন্য আত্মতৃপ্তিলাভের চেষ্টা করতে দেখা যায়। অথচ নানাপন্থায় গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি, হামলা ও মামলার মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধসহ স্বাধীন মত ও চিন্তা প্রকাশের চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর তড়িঘড়ি করে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিপরিষদ খসড়া ‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৩’ নীতিগতভাবে অনুমোদন করায় বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন সদস্যরা। প্রস্তাবিত এই আইন প্রণয়নের সকল কার্যক্রম নির্বাচন পরবর্তী সময় পর্যন্ত স্থগিত রেখে যথা সময়ে সকল অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে অনুমোদিত খসড়ায় বিদ্যমান ক্রটিসমূহ সংশোধন সাপেক্ষে প্রণয়নের আহ্বান জানান তারা। একইসাথে, পোশাক-শ্রমিকদের জীবনমান, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকর্তৃক নির্ধারিত মানদ- বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত নি¤œতম মজুরি শ্রমিকদের প্রত্যাশা ও দাবি এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য বিশেষভাবে আহ্বান জানানো হয় ঘোষণাপত্রে। পাশাপাশি একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিপূর্ণ, পক্ষপাতহীন, প্রতিযোগিতামূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত ক্রয়ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ই-জিপির সুযোগ কাজে লাগাতে উপাত্তনির্ভর বিশ্লেষণ ও তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়াকে জোরদার করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান টিআইবির সদস্যগণ।
মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সততা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, জবাবদিহি চর্চার মাধ্যমে সকল প্রকার শোষণ ও বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি