ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় বিকল্প উদ্যোগ না নেয়ায় ঢাকার ভূগর্ভের পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নামতে নামতে এখন তা এখন এক বিপজ্জনক স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে যেখানে গভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি একশ-দেড়শ মিটার গভীর থেকে তুলে আনা হচ্ছে, বৃষ্টি-বন্যার মাধ্যমে সে স্তরে পানির শুণ্যতা পুরণ করতে শত শত বছর লেগে যায়। নদী ও খালগুলোর অপদখল, জলাধার, পুকুর ভরাট করে শিল্পায়ন ও আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনায়ন ও উন্মুক্ত স্থানগুলো দখল করার কারণে ভূগর্ভের পানির শুন্যতা পুরণ হচ্ছে না। সেই সাথে নতুন উপসর্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে পলিথিনের স্তর। শহরের চারপাশের নদ-নদী, খাল, পুকুর ও উন্মুক্ত স্থানগুলোর মাটির নিচে পলিথিনের কয়েক আস্তরণ সৃষ্টি হয়েছে। এসব পলিথিনের স্তর ভূগর্ভে পানি নি:স্বরনে বাঁধা সৃষ্টি করছে এবং মাটির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে। উজানের ভারতের বাঁধ ও পানি প্রত্যাহার করায় নদনদী শুকিয়ে যাওয়ার কারনে দেশের সেচ ব্যবস্থাও অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় সারাদেশেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভূর্গভস্থ পানি অস্বাভাবিক হরে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের ৫ থেকে ২৪ শতাংশ ভূমি এলাকা পানির সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়া, আর্সেনিক দূষণ, লবণাক্ততা এবং নানাবিধ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মৃদু ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়ে চলেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ফাঁকা হয়ে গেলে বড় ধরণের ভূমিধসের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ণের কারণে আমাদের প্রধান শহর ও জনপদগুলো ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। রাজধানী শহরের পরিবেশগত বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য, অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা, স্বাচ্ছন্দ চলাচল, নাগরিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো যে কোনো দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির মানদন্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। সামগ্রিক মানদন্ডে আমাদের ঢাকা শহর বিগত এক দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। সরকার একদিকে ব্যাপক উন্নয়নের কথা বলছে, অন্যদিকে আমাদের শহর ও জনপদগুলো ক্রমেই অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বিশেষত নদী ও খাল দখল, দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নগর কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে আমাদের শহর ও জনপদগুলো ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ ও মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ঢাকা শহরের চারপাশের নদনদীগুলোর উপর প্রভাবশালী মহলের দখলদারিত্ব ও সীমাহীন শিল্প ও নাগরিক দূষণের কারণে এসব নদনদীর পানি অনেক আগেই ব্যবহারিক উপযোগীতা হারিয়েছে। নদী থেকে পাম্পিং করে যান্ত্রিক পরিশোধনের মাধ্যমে ঢাকার ২ কোটি মানুষের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা। এ কারণে শহরের সবখানে হাজার হাজার বৈধ-অবৈধ গভীর-অগভীর নলকূপ ও পাম্প বসিয়ে নগরবাসির চাহিদা পুরণ করা হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভ থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি উত্তোলনের কারণে ঢাকায় ভূগর্ভের পানির স্তর দ্রুত অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাওয়ার বিপজ্জনক অবস্থা সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন দেশের পরিবেশবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞরা।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতির সম্মুখীন প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বনায়ণ, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, নদনদীর দূষণ রোধ, ফসিল জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে কাবর্ণ নি:সরণ কমিয়ে আনার বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ অন্যতম অংশীদার। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে যে কর্মকান্ডকে অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে নদী রক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। নদীরক্ষা, নাগরিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সুয়ারেজ সিস্টেম ও সড়কে পানিবদ্ধতা রোধের মত কর্মযজ্ঞে পলিথিনের মত দূষণ সৃষ্টিকারী বস্তুর উৎপাদন, অনিয়ন্ত্রিক ব্যবহার ও পরিশোধন ব্যবস্থার উপর জোর দেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকার পরিবেশ দূষণ, চারপাশের নদনদী দূষণ, পয়:নি:স্বরণ ব্যবস্থাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে পলিথিনের মাত্রারিক্ত ব্যবহার এবং যত্রতত্র ডাম্পিং সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, এমনকি সিলেটের সুরমা নদী খনন করতে গিয়ে পলিথিনের অস্বাভাবিক পুরো স্তর অনেক বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছে। পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে গত দুই দশকে সরকার বেশকিছু আইন প্রণয়ন করলেও এসব আইনের সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় নজরদারি না থাকায় তা কোনো কাজে আসছে না।
নদী, খাল ও জলাভূমি পুনরুদ্ধার, দূষণ রোধ ও সংস্কারের মাধ্যমে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ এবং দূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ রক্ষা করতে হবে। প্রভাবশালী মহলের অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে ঢাকার চারপাশের নদনদী, খাল ও জলাভূমি পুনরুদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে অনাগত বিপদ থেকে কেউ রক্ষা পাবো না। আশা কির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ গুরুত্বে সাথে বিচেনায় নিবেন।