রাজধানীর বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে প্রতিদিন জমতো আড্ডার সঙ্গে খাবারের ধুম। বন্ধু, পরিবার-পরিজন নিয়ে এই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরের রেস্টুরেন্টে খেতে যেতেন শিশু-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ। তবে একদিনের ব্যবধানে আলো ঝলমলে সেই ভবনটি এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। আগুনে পোড়া ভবন ঘিরে পুরো এলাকায় বিরাজ করছে ভুতুড়ে পরিবেশ। ভবনটিতে বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাতে লাগা ভয়াবহ আগুনে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। দগ্ধ অনেকে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আগুনের ঘটনায় প্রাণোচ্ছল বেইলি রোড এলাকায় এখন সুনসান নীরবতা। শুক্রবার দিনভর ওই সড়কে যথারীতি গাড়ি চলাচল করলেও সেখানকার মানুষের চোখেমুখে দেখা গেছে এক অজানা ভীতি ও আতঙ্কের ছাপ।
ব্যস্ততম নগরী ঢাকায় একের পর এক বড় বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। অকালে ঝরছে শত শত প্রাণ। এসব ঘটনায় কোনো গাফিলতি রয়েছে কি না সেটা যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত হচ্ছে না, অন্যদিকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বারবারই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। রাজধানীতে গত ১৪ বছরে বিভিন্ন সময়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ২৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। যেখানে নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর ঢাকার আগুন ট্র্যাজেডির তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে বেইলি রোডের আগুন। এছাড়াও বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ গত কয়েক বছরে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি বড়সড় অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণহানি যেমন হচ্ছে, স্বজন হারিয়ে পথে নামছে অনেক পরিবার। এ মৃত্যুর শেষ কোথায়, যেন উত্তর মেলে না কোথাও।
নিমতলী ট্র্যাজেডি: ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলী মহল্লায় একটি বড় অগ্নিকা- ঘটে। যা নিমতলী অগ্নিকা- বা নিমতলী ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। এ অগ্নিকা-ে ১২৪ জন মানুষ নিহত হন। বাংলাদেশ সরকার এই ভয়াবহ অগ্নিকা-ে নিহতের স্মরণে ২০১০ সালের ৫ জুন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। রাসায়নিকের গুদামে রাখা দাহ্য পদার্থের কারণেই পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়। নিমতলী ট্রাজেডির পর টাস্কফোর্স গঠন, অঙ্গীকার ও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রাজধানী থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নিতে গঠন করা হয় দুটি কমিটি। সেসব কমিটি কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে জায়গা ঠিক করার সুপারিশসহ উচ্চ মাত্রার বিপজ্জনক পাঁচ শতাধিক রাসায়নিকের তালিকা করে প্রতিবেদন দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি: ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় ওয়াহেদ ম্যানশন নামের একটি ভবনে হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ভবনে কেমিক্যাল গোডাউন থাকায় মুহূর্তে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সড়কে যানজটে আটকে থাকা পিকআপভ্যান, প্রাইভেটকার, রিকশা ও মোটরসাইকেলে। ঘটনাস্থলেই পুড়ে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। দগ্ধ ১৫ জনের মধ্যে ৪ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১।
এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডি: বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় লাগা আগুনে ২৭ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক মানুষ আহত হন। নিহতদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও ছিলেন। ২২ তলা ওই ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। অগ্নিকা-ের পর আগুন দ্রুত অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ভেতর আটকা পড়া অনেকে ভবনের কাঁচ ভেঙে ও রশি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। এসময় কয়েকজন নিচে পড়ে গিয়ে নিহত হন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট। একই সঙ্গে বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা উদ্ধারকাজে যোগ দেন। এছাড়া ঘটনাস্থলে ৪০-৫০টি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সেবা দেওয়া হয়। বিকেল ৩টার দিকে উদ্ধারকাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়াও হেলিকপ্টার দিয়ে পাশের গুলশান-বনানী লেক থেকে পানি সংগ্রহ করে ভবনে ছিটানো হয়। বিকেল ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
মগবাজার বিস্ফোরণ: ২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ হয়। আড়ংয়ের শোরুম ও রাশমনো হাসপাতালের উল্টো দিকের মূল সড়ক লাগোয়া সেই ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই বিকট ছিল যে প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা তখন জানিয়েছিলেন, এমন বিকট আওয়াজ তারা আগে শোনেননি।
ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলেন, শর্মা হাউস নামে ফুডশপে গ্যাস জমে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে, প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই ট্রান্সফরমার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যেকটি ভবনের জন্য একটি নবায়নযোগ্য সনদের ব্যবস্থা করা হোক। দোতলা, দশতলা, বিপণিবিতান কিংবা কমার্শিয়াল ভবন হোক, এটি প্রত্যেকটি ভবনের বসবাসযোগ্যতা ও নিরাপদ ভবনের নিরাপত্তাজনিত সার্টিফিকেশন। প্রতি বছর এর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশে এ প্রক্রিয়া রয়েছে। ভবন ইন্সপেকশন ছাড়া দিনের পর দিন আপনি ভবনে বসবাস করতে পারবেন না। প্রতি বছর ভবন ইন্সপেকশন হয়। পরে যদি কোনো ঘটনা ঘটে তবে ওই ইন্সপেকটরের বিভিন্ন রকম শাস্তি হয়। অতএব উন্নত দেশেগুলোর মতো এ কাজটি আমাদের দেশে শুরু করা জরুরি।
বেইলে রোডে আগুনের দায় কার: ফায়ার সার্ভিস সূত্র ও ভবনটির রেস্টুরেন্টগুলোতে বিভিন্ন সময়ে খেতে যাওয়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে প্রবেশ করার রাস্তা ছিল মাত্র একটি। সেটি নিচতলার চায়ের চুমুক নামে একটি রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে। নিচতলায় রয়েছে দুটি লিফট ও একটি সরু সিঁড়ি। আর সিঁড়িটি এত সরু যে সেখান দিয়ে দুজন মানুষ এক সঙ্গে ওঠা-নামা করা যায় না।
এ বিষয়ে ওই ভবনে মাঝে মাঝে খেতে যাওয়া নাবিল হক নামে এক তরুণ বলেন, সিঁড়িটি এত সরু যে দুজনের বেশি একসঙ্গে উপরে উঠতে গেলে কিংবা নিচে নামতে গেলে সমস্যা হয়।
ফ্লোরে ফ্লোরে ছিল রেস্টুরেন্ট: গ্রিন কোজি কটেজ নামের ওই ভবনটি বেইলি রোডের সবচেয়ে জমজমাট ভবন। সাততলা ভবনটির অধিকাংশ ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ফলে সারাদিনই সেখানে মানুষের যাতায়াত ছিল। তবে সন্ধ্যার পর মানুষের জটলা থাকত বেশি। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে ৫০ শতাংশ ছাড় ছিল। ফলে সেখানে কাস্টমার বা অতিথির উপস্থিতি অনেক বেশি ছিল।
সাততলা ভবনটিতে যা ছিল: ভবনের প্রথম তলায় চায়ের চুমুক রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়া ছিল গ্যাজট অ্যান্ড গিয়ার, স্যামসাং, শেখ হোলিক ও ওয়াফে বে নামে চারটি শোরুম। দ্বিতীয় তলার পুরোটা জুড়ে ছিল কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট। তৃতীয় তলায় ইলিয়ানের পাঞ্জাবির শো-রুম। চতুর্থ তলায় খানাস নামে একটি রেস্টুরেন্ট, প ম তলায় পিৎজা হাট, ষষ্ঠ তলায় স্টিট ওভেন ও জেস্টি নামে দুটি রেস্টুরেন্ট এবং সপ্তম তলায় ফোকুস ও হাক্কা ডাকা নামে দুটি রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়া ভবনটির ছাদেও এম্বোশিয়া নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল।
কাচ্চি ভাইয়ের ফ্লোরে হতাহত বেশি: ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, আগুনে হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের ফ্লোরটিতে। এ রেস্টুরেন্ট থেকে কমপক্ষে ১৫টির বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, আমরা ভবনের চারটি ফ্লোর থেকে মরদেহ উদ্ধার করি। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও প ম তলা থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয় দ্বিতীয় তলার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট থেকে। কাচ্চি ভাইয়ের ফ্লোর থেকে বেশি মরদেহ উদ্ধারের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না। ঘটনার সময় সেখানে মানুষের উপস্থিতও ছিল বেশি। ভেন্টিলেশন না থাকায় ধোঁয়া বের হতে পারেনি। দম বন্ধ হয়ে অনেকে মারা যান।
রেস্টুরেন্টের জন্য অনুমতি ছিল না ভবনটির: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, গ্রিন কোজি কোটেজ নামে ভবনটির ডেভেলপার আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ। ভবনটির সব ফ্লোর ব্যবহার হচ্ছিল বাণিজ্যিকভাবে। তবে রেস্টুরেন্টের জন্য ব্যবহারের কোনো অনুমতি ছিল না এ ভবনের।
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অ ল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভবনটির এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্টুরেন্ট, শো-রুম বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
আগুনের সূত্রপাত নিচতলার চায়ের চুমুক থেকে: প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ভবনটির নিচতলায় চায়ের চুমুক নামে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। পরে মুহূর্তে পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র এক মাস আগে ভবনটির নিচ তলায় চায়ের চুমুক রেস্টুরেন্টটি যাত্রা শুরু করেছিল।
৮০ ভাগ মানুষ ধোঁয়ায় মারা যান: বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি ছিল আবদ্ধ। আলো-বাতাস প্রবেশের পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। আটকাপড়া ব্যক্তিদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন তৃতীয় তলার একটি কক্ষে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তারা বের হতে পারেননি। কক্ষ থেকে উদ্ধার হয় ৯ জনের মরদেহ। অধিকাংশই মারা গেছেন ধোঁয়ায়। ধোঁয়া থেকে বাঁচতে জানালা খুঁজেছিলেন তারা। দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে তাদের হাতের ছাপ। ঘটনার পরদিন শুক্রবার (১ মার্চ) সকালে ওই ভবন থেকে বেরিয়ে এমন বর্ণনা দেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সঙ্গে তিনি ওই ভবন পরিদর্শন করেন।
ইকবাল হাবিব বলেন, পুরো ভবন আবদ্ধ, আলো-বাতাস প্রবেশের কোনো জায়গা ছিল না। ২০ ভাগ মানুষ আগুনে পুড়ে আর ৮০ ভাগ মানুষ ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। এটা হয়েছে, কারণ বের হয়ে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না। আমি যে কক্ষে গেছি সেখানে ফায়ার সার্ভিস আমাকে দেখাল, এখানে ৯টি মরদেহ পড়েছিল। ওই রুমের বিভিন্ন জায়গায় খামচির দাগ ছিল। তারা কোনো না কোনো একটা জানালা-দরজা খোলার চেষ্টা করেছিল, বাতাস নেওয়া জন্য। এটা ভয়াবহ হত্যাকা-। আশপাশে ওয়ালে তারা জানালা খুঁজেছেন, কিন্তু কিছুই নাই। ভবনে ভেন্টিলেটর না থাকা একটা চূড়ান্ত অপরাধ। এ ঘটনা আমাদের নতুনভাবে ভাবাতে শুরু করেছে।
চুমুক রেস্টুরেন্টের দুই মালিক ও কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজার আটক: ভবনের নিচতলার চুমুক রেস্টুরেন্টের (ছোট রেস্টুরেন্ট) দুজন মালিক ও কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আটকরা হলেন- চা চুমুকের মালিক আনোয়ারুল হক ও শাকিল আহমেদ রিমন এবং কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজার জিসান। শুক্রবার (১ মার্চ) রাতে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ মহিদ উদ্দিন।
ঢামেক থেকে ৪০ মরদেহ হস্তান্তর, মর্গে আরও ৬: আগুনে নিহত ৪০ জনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর মর্গে রয়েছে আরও ছয়জনের মরদেহ। তাদের মধ্যে এক শিশু ও নারীর কোনো স্বজন মরদেহের খোঁজে আসেননি। বাকি তিন পুরুষের মরদেহ ডিএনএ টেস্ট করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এছাড়া শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মর্গে আগুনে নিহত সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ওরফে বৃষ্টি খাতুনের মরদেহ শুক্রবার রাতে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শুক্রবার (১ মার্চ) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দায়িত্বরত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল জব্বার মরদেহ হস্তান্তরের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ইমারত বিধিমালা ন্যক্কারজনকভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে: ভবন নির্মাণে ইমারত বিধিমালা ন্যক্কারজনকভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেছেন, এ ক্ষেত্রে তদারকির গাফিলতি রয়েছে, তদারকি পর্যাপ্ত হচ্ছে না। শুক্রবার (১ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে আগুন লাগা বহুতল ভবন পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
মেয়র বলেন, বিভিন্নভাবে নকশা অনুমোদন করা হচ্ছে, কিন্তু সেসব নকশায় ইমারত বিধিমালা মানা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে নকশা ঠিক থাকলেও যখন ভবন নির্মাণ হচ্ছে তখন ব্যত্যয় হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর নজর দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু নজর দিয়ে আমরা কী পাচ্ছি? একই কারণ পাচ্ছি, ইমারত বিধিমালা ন্যক্কারজনকভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৌশলী থেকে স্থপতি ও যারা মালিক সবাইকেই সেই দায়িত্ব বহন করতে হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নিমতলীতে ১২৪ জন মারা যাওয়ার পর কী হয়েছে? কিছুই হয়নি। নিমতলীর পর চুড়িহাট্টার ঘটনা ঘটেছে, আবার বনানীতে আগুনে ৪৮ জন মারা যায়। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে ৪৬ জন মারা গেছে। এ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে শুনেছি আমি। শুক্রবার বিকেলে বেইলি রোডের অগ্নিকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি এসব কথা বলেন।
পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন: বেইলি রোডে অগ্নিকা-ের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি ও ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিনকে সদস্য সচিব করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সংশ্লিষ্ট জোনের ডিএডি, সিনিয়র স্টেশন অফিসার ও ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর।
ভবনে ফায়ার এক্সিট না থাকায় হতাশ প্রধানমন্ত্রী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর বেইলি রোডের বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নি নির্গমন পথ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছি, তবুও মানুষ এতটা সচেতন নয়। আপনি একটি বহুতল ভবনে আগুন দেখেছেন, যার কোনো অগ্নি নির্গমন ব্যবস্থা নেই। শেখ হাসিনা শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় বিমা দিবস-২০২৪ উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
বেইলি রোডে বৃহস্পতিবার রাতে বাণিজ্যিক ওই ভবনে অগ্নিকা-ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, একটি বহুতল ভবন হলেও সেখানে কোনো অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। তিনি স্থাপত্যবিদদের অনুরোধ করেন, ভবন বা স্থাপনা তৈরির সময় সব সময় যেন খোলা বারান্দা বা ভেন্টিলেশন এবং অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, অগ্নিকা-ে অনেকে মারা গেছেন। এই মৃত্যু কাম্য নয়। এই মৃত্যু কখনো মেনে নেওয়া যায় না। এই ভবনটিতে একটি মাত্র সিঁড়ি আছে। ধোঁয়ার কারণে মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। সেখানে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন ছিল না। আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি, আমরা দেখতে চাই কারও কোনো গাফিলতি ছিল কি না।
তিনি বলেন, এই ভবনে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল কি না আমরা তদন্ত করে দেখতে চাই। এছাড়া ভবন নির্মাণ করতে অন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমতি লাগে তা ছিল কি না সেটাও আমরা তদন্ত করে দেখব। আমরা তদন্তে দেখতে পাবো কীভাবে আগুন লেগেছে এবং এখানে কারও কোনো গাফিলতি ছিল কি না। ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি ছিল, কিন্তু সেটা না করে রেস্টুরেন্টসহ দোকান করা হয়েছে। এ অভিযোগের বিষয়ে আবদুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, আমরা শুধু ফায়ার সেইফটি প্ল্যানটা দেখি। এ বিষয়ে রাজউক বলতে পারবে। তবে এ বিষয়টি আমরাও তদন্ত করে দেখবো।
তিনি বলেন, ভবনটিকে আগেও ফায়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা মনে করি যারা ব্যবসা করেন তাদের সবাইকে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার। আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল নিচতলা থেকে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন ছিল জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, রাজধানীর বেইলি রোডের ওই ভবনে একাধিক রেস্টুরেন্ট ছিল, ছিল সিলিন্ডারও। এজন্য ভবনটি ছিল অগ্নিচুল্লির মতো। যার জন্য দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সেইফটি প্ল্যান ছিল না। ভবনে আমরা দু-একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখতে পেয়েছি। পুরো ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি ছিল। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লাগতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত আগুন লাগার সঠিক কারণ জানা যায়নি।-সূত্র: জাগো নিউজ