রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০২ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম গণমাধ্যম হতে পারছে না: কাদের গনি চৌধুরী

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম গণমাধ্যমের হতে পারছে না। সত্য তুলে ধরতে না পারায় সংবাদমাধ্যম দিন দিন মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এটি সংবাদমাধ্যমকে অস্তিত্বের সংকটে ধাবিত করছে। গণমাধ্যম সব সময় জনগণের পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু কীভাবে জানি না, জনগণের সাথে গণমাধ্যমের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কালে কালে সে দূরত্বটা বাড়ছেই শুধু। আমরা জানি না আমাদের মিডিয়া মালিকরা তা অনুধাবন করছেন কিনা!
গতকাল শুক্রবার সকালে সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এসব বলেন।
সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সভাপতি মির্জা সেলিম রেজার সভাপতিত্বে শহরের টিএমএসএস অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত এ কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা।
সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুল ওয়াদুদের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক গনেশ দাস, সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সাবেক সভাপতি মতিউল ইসলাম সাদী, বগুড়া প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রেজাউল হাসান রানু, সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার কার্যনির্বাহী সদস্য (সদ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক) এস এম আবু সাঈদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সাবেক সভাপতি সৈয়দ ফজলে রাব্বি ডলার, সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোমিন রশিদ শাইন, দৈনিক নয়া দিগন্তের বগুড়া অফিস প্রধান আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক করতোয়ার স্টাফ রিপোর্টার রাহাত রিটু, দৈনিক বগুড়ার স্টাফ রিপোর্টার জহুরুল ইসলাম, দৈনিক মানবজমিনের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি প্রতীক ওমর, সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সহসভাপতি আ: রহিম, সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সদ্য নির্বাচিত কোষাধ্যক্ষ ফেরদৌস রহমান, মাহফুজ মন্ডল, টিএম মামুন, মৌসুমী আক্তার প্রমুখ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে সংবাদমাধ্যম গণমুখি সস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে।
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকের কাজ রাজনীতি করা নয়। তবে ভালোর পক্ষে কল্যাণের পক্ষে থাকতে হবে। সাংবাদিকরা হবে সত্যের পন্থি। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলবে। বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারহরণ, ভোটাধিকারহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ণ, শোষণ, অবিাচরের বিরুদ্ধে কথা বলবে সাংবাদিকরা। এজন্যই গণমাধ্য আর সাংবাদিকদের ভরসার শেষ ঠিকানা মনে করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতা না থাকায় সংবাদমাধ্যম আজ গণমুখী সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে। সরকার নানাধরণের কালাকানুন তৈরি করে গণমধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করেছে। আজ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ততটুকুই আছে যতটুকু সরকারের পক্ষে যায়’।
তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে বেশির ভাগ মিডিয়ার মালিক হয় রাজনীতিক না হয় ব্যবসায়ী। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মিডিয়াকে ব্যবসায়িকভাবে টিকিয়ে রাখার কৌশলের অংশ হিসেবে বাক্স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক তথ্য অধিকার হরণকারী কালা কানুন মেনে চলার পথ বেছে নিয়েছেন এসব মালিকরা। মোর্দা কথা মিডিয়াকে ব্যবসায়ীরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এখানে সরকারি দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রী, প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা কিংবা সচিবদের অপব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে, প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে, রাষ্ট্রীয় খরচের মডেল নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না। ফলে চুরি, লুণ্ঠন, জালিয়াতি, ঘুষ, তদবির, চাঁদাবাজিকেন্দ্রিক দুর্বৃত্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র মৌলিক দায়বদ্ধতার বিষয় অনুপস্থিত। সমালোচনার সীমা রেখা এতোটা সীমিত করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ব্যক্তির নাম মুখেও আনা যায় না।আইন করে কোন কোন নেতার সমালোচনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে! ফলে সংবাদমাধ্যম ‘গণমানুষ’কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না বরং প্রশাসনসহ ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের সার্বিক রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, মালিকদের লিপ্সার কারণে সেলফ সেন্সরশিপের সংস্কৃতিতে মিডিয়াকর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এরফলে সরকারের বিধিনিষেধের চাইতেও মালিকদের দলদাস প্রবণতা গণমাধ্যমের চরিত্র নষ্ট করে ফেলছে।সম্পাদকরা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে প্রশ্ন না করে তৈল মর্দনে ব্যস্ত থাকেন। তিনি বলেন, আজ একটি কঠিন সত্য না বললেই নয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভাষার রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর পাঠক-শ্রোতাদের রাজনীতিকে গাইড করতে চায়। কোনটা ‘তা-ব’, কোনটা ‘হামলা’, কিংবা কোনটা ‘সংঘাত’ এটা ওই ঘটনা নির্ধারণ করে দেয় না, বরং সংবাদমাধ্যমের তা নির্ধারণ করে দেয়। এখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দ্বারা ঘটিত ঘটনাও ভাষার রাজনীতিতে পড়ে কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক আবার কারো ক্ষেত্রে মহাঅপরাধে পরিণত হয়। পছন্দের দলের ক্ষেত্রে বলা হয় ‘অভিযোগ’। আর বিরোধীদের ক্ষেত্রে দেখানো হয় অকাট্য সব প্রমাণ। একই প্রকারের কোনো ঘটনা হয় ‘হামলা ও তা-ব’, কোনটা হয় ‘দুই পক্ষের সাধারণ সংঘাত’। সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলের মারামারি হলে সরকারি দলের ক্ষেত্রে লিখা হয় বিক্ষুব্ধ জনতা আর আর বিরোধী দলের ক্ষেত্রে লিখা হয় অমুক দলের সন্ত্রাসী বা ক্যাডাররা। ঘটনা বর্ণনার ভাষা এখানে ঘটনা নিরপেক্ষ নয়, বরং মতাদর্শই ভাষা ও শব্দ নির্মাণ করে। আমাদের মিডিয়া যেন ক্ষমতাহীন ‘গণমানুষে’র রাজনীতির ভাষাকেই ঠিক করে দিতে চায়। বলা চলে প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক পক্ষপাত তার ভাষার রাজনীতি প্রতিফলিত হচ্ছে।তাই প্রশ্ন উঠেছে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ না করা সংবাদমাধ্যম কি গণমাধ্যম বলে বিবেচিত হতে পারে?
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন,ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কিংবা সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের নয়। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নাগরি স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করা। আজকে একই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ছয়টি-সাতটি মিডিয়া হাউসের লাইসেন্সও জমেছে। ফলে বৈধ-অবৈধ ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে কোনো বাধা নেই। তাদের অবৈধ ব্যবসায়িক সম্প্রসারণকে, মালিকপক্ষের অপরাধ, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে সংবাদে আনার সাধ্য কারও নেই। আমাদের গণমাধ্যম ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের গণতন্ত্র নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকে, কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা, ডামি ভোট,রাতের ভোট, একদলীয় নির্বাচন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ঘটনায় আমাদের গণমাধ্যম থাকে বেশ নির্ভার। আমাদের গণমাধ্যম ব্যাংক লুট, পাচার, প্রকল্প ব্যয়ে সীমাহীন দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণ, উন্নয়ন প্রকল্পের বাজে মান, শিক্ষার নি¤œমান, স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা, স্বাস্থ্য-দারিদ্র্য, পুষ্টি-দারিদ্র্য, দারিদ্র্য ফাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে, প্রাতিষ্ঠানিক অপশাসনের সংযোগকে প্রশ্ন করতে পারে না। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা তৈরির সময়ে সে চুপ থাকে, পরে সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে সে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে। ফলে জনস্বার্থ ও জনকল্যাণের জন্য তার নিবেদন প্রশ্নযুক্ত। একটা বড় ঘটনা ঘটে গেলে তথ্য প্রকাশে হীনমন্য সব সিদ্ধান্তের ভেতর হাঁটতে হয়। ছাপা পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শোভা পায় নাগরিক স্বার্থকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বাহাস। রাজনৈতিক কূটতর্ক দিয়ে নাগরিক কষ্ট, মানুষের অধিকার এবং নাগরিক দাবি ভুলিয়ে রাখাই যেন গণমাধ্যমের এজেন্ডা।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com