সব রেকর্ড ছাড়িয়ে দেশের সর্বোচ্চ তাপামাত্রা ৪৩ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) এটিই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর আগে গত সোমবার (২৯ এপ্রিল) এই জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। আজকের তাপমাত্রা বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ মে এ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এবার সেই তাপমাত্রাও অতিক্রম হলো। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, তাহলে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কত ডিগ্রিতে উঠেছিল। অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, আজ যশোরে সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এটিই চলতি মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্র। তিনি আরও জানান, আজ চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ দশমিক সাত ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকার তাপমাত্রা ৩৮ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
বৃষ্টির বিষয়ে জানতে চাইলে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, আগামী ২ থেকে ৭ মে পর্যন্ত সময়ে বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলেই যে তাপমাত্রা অনেক কমে যাবে, বিষয়টি তা নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এদিকে চুয়াডাঙ্গায় এপ্রিল মাসের ৯ দিনই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবারও জেলায় দেশের সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। মঙ্গলবার (৩০ সএপ্রিল) দুপুরে তাপমাত্রা ছাড়ায় আগের সব রেকর্ড। তাপমাপার মিটারের পারদ ছুঁয়ে ফেলে ৪৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জেলার মানুষ ভ্যাপসা গরম ও তাপদাহ থেকে বাঁচতে রীতিমতো অসহনীয় কষ্ট করছে। খেটে খাওয়া মানুষ বাইরে বের হতে পারছে না। ব্যাহত হচ্ছে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
হিটস্ট্রোকে মৃত্যু: সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে হিটস্ট্রোকে আরও তিনজন মারা গেছেন। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন ১০ জন। সোমবার (২৯ এপ্রিল) এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, হিটস্ট্রোকে মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন মারা গেছেন মাদারীপুর জেলায়। আরেকজন মারা গেছেন চট্টগ্রামে। তবে গত একদিনে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত নতুন কেউ হাসপাতালে ভর্তি হননি। সবমিলিয়ে বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ৫ জন চিকিৎসাধীন আছেন বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে, সোমবার দেশের চার জেলার তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়েছে অর্থাৎ অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এটিই এখন পর্যন্ত চলতি মৌসুমের সবচেয়ে তপ্ত দিন। আজ দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল চুয়াডাঙ্গায়। এর আগে এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি উঠেছিল চুয়াডাঙ্গায়। তীব্র গরমে প্রায় সারাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত। গত ৩১ মার্চ থেকে টানা চলছে তাপপ্রবাহ। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। প্রচ- গরমে পাওয়া যাচ্ছে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর খবর।
হিটস্ট্রোকে এক সপ্তাহে সাতজনের মৃত্যু:হিটস্ট্রোকে গত এক সপ্তাহে সারা দেশে সাতজন মারা গেছেন। এ ছাড়া হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এ তথ্য জানিয়েছে। এক সপ্তাহ আগে থেকে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে হিটস্ট্রোকের রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেছে। ২২ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যে হিটস্ট্রোকে সাতজনের মৃত্যু ও পাঁচজনের হাসপাতালে ভর্তির তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি), বমি বমি ভাব থাকে, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, ঘাম হতেও পারা আবার না–ও পারে, ত্বক গরম ও শুষ্ক অথবা স্যাঁতসেঁতে থাকতে পারে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি সামঞ্জস্যহীন আচরণ করে, তার কথা জড়িয়ে যায়, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, হবিগঞ্জ, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও বান্দরবানে একজন করে হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা সবাই পুরুষ। তাঁদের বয়স ৩২ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে। তাঁদের প্রত্যেকের বাড়ি গ্রামা লে।
হিটস্ট্রোকে ভর্তি হওয়া পাঁচজনের দুজন নারী। দুজনের বয়স ৪৫ বছরের বেশি। বাকি তিনজন পুরুষের একজনের বয়স ১২ বছর।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা ধারণা করছেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রথমত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন শুধু সরকারি হাসপাতালের হিসাব নিচ্ছে, দেশের বিপুলসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কোনো রোগী যাচ্ছে কি না, তা জানা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, রোগীর কোন লক্ষণ দেখে হিটস্ট্রোক শনাক্ত হবে সেই ধারণাও চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে পরিষ্কার ছিল না। অতিসম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছে এবং সেই নির্দেশিকা অনুসরণ করে সরকারি চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। প্রশিক্ষণ পাওয়া চিকিৎসকেরা যাকে হিটস্ট্রোকের রোগী বলছেন, তাঁরাই হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাবে থাকছেন।
তাপমাত্রা বাড়লে, উষ্ণ তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে অসুস্থতাও বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৩ ও ২০০৭ সালের মধ্যে দেশে তাপপ্রবাহের দেশেগুলোয় মৃত্যু ২২ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, হিটস্ট্রোক ছাড়াও গরমজনিত আরও কিছু সমস্যা হয়। এর মধ্যে আছে: তাপজনিত শ্রান্তি, তাপজনিত সংজ্ঞালোপ, তাপজনিত পেশিসংকোচন, তাপজনিত ফুসকুড়ি। আর হয় তাপজনিত পানিশূন্যতা। প্রচ- তাপ বিশেষ প্রভাব ফেলে অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু ও প্রবীণদের ওপর। এ ছাড়া যেসব মানুষ দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, তাঁদের ঝুঁকি বাড়ে গরমে।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, তাপপ্রবাহের কারণে রোগ ও মৃত্যু বাড়ে এটা প্রমাণিত। এটাও সত্য যে এ বছরের মতো তাপের মধ্যে আমাদের আগামী বছরগুলোতেও পড়তে হবে। সে জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের জোর প্রস্তুতি থাকতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ থাকা, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচার–প্রচারণা চালাতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে আগামী বছর যেন হিটস্ট্রোকে বা তাপপ্রবাহের কারণে কারও মৃত্যু না হয়।