ঘুষের হার সর্বনিম্ন এক হাজার। ক্ষেত্রবিশেষে লাখ টাকাও হতে পারে। আবার বড় কোনো প্রকল্প হলে কোটি থেকে শত কোটির লেনদেনও অস্বাভাবিক নয়। সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লক্ষ কোটি অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা দুর্ভোগ-দুর্দশায় কাতরাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে হিন্দি সিনেমার নায়ক অনিল কাপুর অথবা কলকাতার বাংলা সিনেমা ফাটাকেস্ট মিঠুনের মতো হিরো সেজে দু’চারজন কর্তাব্যক্তি বেশ লম্ফঝম্প মারেন। কথার ফুলঝুরিতে সারা দেশে বসরাই গোপালের গন্ধ ছড়াতে থাকেন। তারপর একদিন দেখা যায় নায়ক বা ফাটাকেস্ট চুপ। আর সাথে সাথে ঘুষের রেটও বেড়ে যায় মারাত্মকরূপে।
বাংলাদেশের কুখ্যাত ওসি প্রদীপের হাজার কোটি টাকার সম্পদ এবং শত শত ক্রসফায়ারের কাহিনী শুনে যারা জ্ঞান হারান কিংবা আইজি বেনজীরের সম্পদের বহর দেখে টাসকি খান এবং চোখ উল্টিয়ে বমি করার চেষ্টা করেন, তারা হয়তো জানেন না এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে কোন জায়গায় দিনের আলোতে কত শত ওসি প্রদীপের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়ায় কিংবা গণ্ডায় গণ্ডায় বেনজীরের প্রতিচ্ছায়া কোটি মানুষের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরায়। যারা ধরা পড়ে আমরা তাদের নিয়ে মাতামাতি করি। কিন্তু যারা দুর্নীতির পাহাড়-পর্বত গিলে খায় এবং অনায়াসে সমস্বরে জাতিকে নসিহত করে তাদেরকে আমরা উল্টো তোয়াজ করি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কাছে মাথা নোয়াই বা তাদের পা চেটে স্বার্থ হাসিল করে নিজেদের ধন্য মনে করি।
এমন একটি সময় ভাবতাম, বাংলাদেশের কিছু লোকের কয়েক ডজন রোলেক্স, প্যাটেক ফিলিপ, ওমেগা বা রাডোর মতো ঘড়ি থাকে কি করে! যেখানে একটি ঘড়ির দাম গড়ে ১০ লাখ থেকে ১০ কোটি আবার কোনো কোনোটির দাম শত কোটি টাকা সেখানে কয়েক ডজন ঘড়ির দাম কত হতে পারে! এসব ঘড়ি কারা কেনে, কারা পরিধান করে, কারা উপহার দেয়- এসব অঙ্কের হিসাব কোনো দিন মেলাতে পারিনি। দামি ঘড়ি ছাড়াও কিছু লোক দামি জামা কাপড় পরেন। পাঁচ লাখ বা তার চেয়েও বেশি মূল্যের শত শত স্যুট-কোট, লাখ টাকা দামের জামা-জুতা-বেল্ট-চশমা-ব্রেসলেট এবং লাখ টাকা থেকে শুরু করে কোটি টাকা মূল্যের কলম পকেটে ঝুলিয়ে কিছু লোক কেন ছংভং করেন তা নিয়ে বহু চেষ্টা করেও দু’লাইন কবিতা লিখতে পারিনি!
উল্লিখিত বিষয়াদি ছাড়া জায়গা-জমি, বাড়ি-গাড়ি ও নারীর মোহে কিছু লোক নিজ নিজ দফতরে দুর্নীতির বন্যা ছুটিয়ে দেয়। শ’খানেক ফ্ল্যাট, শত বিঘা জমি এবং দেশ-বিদেশের শত শত ব্যয়বহুল সোসাইটি গার্লদের নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে বালাখানার নাসর হওয়ার জন্য কত মানুষের কত রকম হম্বিতম্বি যে জনগণের জীবন কিভাবে জাহান্নামে পরিণত করেছে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। আমাদের মাটিতে অতীতে যেভাবে মীরজাফর, জগৎশেঠের জন্ম হয়েছে ঠিক তদ্রুপ কলিকালে আমরা পি কে হালদার কিংবা শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর মতো অগ্নিসন্তানদের পেয়েছি। আগুনের তৈরি ইবলিশ যেভাবে আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চোখের সামনে ঘোরে মাথার মধ্যে ঢুকে যায় এবং কলিজার মধ্যে প্রবেশ করে পুরো কলিজা এবং ফুসফুসে সুড়সুড়ি দিতে থাকে তদ্রুপ হালফ্যাশনের অগ্নিপুত্ররা সবার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু আমরা দেখি না। আমাদের কান মলে দিয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচার করে সীমান্ত পাড়ি দেয় আর আমরা ভয়ে চোখ বুঁজে থাকি।
আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা শেখের বেটা বাচ্চুকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে পাগল হওয়ার উপক্রম হয়েছেন। সাংবাদিকরা লিখতে লিখতে কলম ভেঙে ফেলেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তাকিয়ে থাকতে গিয়ে রীতিমতো মহাকবি হয়ে গেছে কিন্তু শেখের বেটার টিকিটি স্পর্শ করা যায়নি। অন্য দিকে, ব্যাংক লুট, রিজার্ভ চুরি, শেয়ার মার্কেট লুট এবং টাকা পাচার নিয়ে চিন্তাভাবনা, বাদ-প্রতিবাদ করতে করতে অনেকে কবরে চলে গেছেন কিন্তু লুটেরাদের কিছুই হয়নি, উল্টো অনেকে নতুন করে ফিনিক্স পাখির মতো নবজন্ম লাভ করেছেন, অনেকে নিকৃষ্ট প্রাণীর মতো বংশবিস্তার করেই চলেছে এবং কেউ কেউ রীতিমতো সিদ্ধিবাবা ধনানন্দে পরিণত হয়েছেন।
আজকের শিরোনাম নিয়ে লিখতে বসে আমার অবস্থা হয়েছে বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের মতো। আজ থেকে প্রায় ২২৫০ বছর আগে গ্রিক সভ্যতার যুগে তিনি গ্রিক রাজা দ্বিতীয় হিয়োরোর জন্য একটি গবেষণাকর্ম করছিলেন। রাজার জন্য তৈরি স্বর্ণ মুকুটে খাদ আছে নাকি নেই, এটি বের করার দায়িত্ব লাভের পর তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। একদিন একটি চৌবাচ্চায় উলঙ্গ হয়ে গোসল করার সময় হঠাৎ তিনি তার ইতিহাস বিখ্যাত আবিষ্কারের সূত্রটির সন্ধান পান যা মহাকালে অনিয়মিত আকারের বস্তুর আয়তন পরিমাপের পদ্ধতিরূপে পরিচিত। এই সূত্রের ওপর ভিত্তি করেই তিনি নির্ভুলভাবে বলে দিয়েছিলেন, রাজার মুকুটে কতটুকু খাদ মেশানো হয়েছে। তো তিনি যখন সূত্রটি আবিষ্কার করলেন, ঠিক তখনই চিৎকার করে উঠলেন- ইউরেকা! ইউরেকা! অর্থাৎ পেয়েছি! পেয়েছি! তারপর মনের আনন্দে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় দরবারে উপস্থিত হলেন।
বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের মতো উলঙ্গ হয়ে এ যুগে কেউই পৃথিবীর কোনো রাজার দরবারে যেতে পারবেন না। তবে নষ্ট রাজনীতির বলির পাঁঠা হয়ে লক্ষ কোটি মানুষ আপন গৃহে কিভাবে প্রতিনিয়ত আপন মনে দুঃখ কষ্ট ও বেদনার ছোবলে বস্ত্রহীন হয়ে পড়ছেন সেই চিন্তা মাথায় এলে আমি কিভাবে উলঙ্গ হয়ে পড়ি সেই কাহিনী আজ আপনাদের জানাব।
দুর্নীতির রাহুগ্রাসে আমাদের জাতীয় ঋণ বাড়ছে। প্রত্যেক নাগরিকের ওপর বিশাল অঙ্কের দেশী-বিদেশী ঋণের বোঝা চেপে বসছে, এমনকি আজকের দিনে যে শিশুটি জন্ম নিলো তার মাথায় লাখ টাকার বিদেশী ঋণ। ফলে আমার গাড়ি-বাড়ি, টাকা-কড়ি যাই থাকুক না কেন, জাতিগতভাবে প্রত্যেক নাগরিকের মতো আমিও ঋণগ্রস্ত। ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যেকের মাথায় ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া দুর্নীতির মহারাজদের দুর্নীতির সূত্র খুঁজতে গিয়ে আমার প্রায় পাগল হওয়ার দশা।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতির যে বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে সেখানে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দুর্নীতি কিভাবে দুর্নীতির সাগর রচনা করে তার কয়েকটি উদাহরণ দিলেই আপনার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধরুন, বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ গাড়ি রাস্তায় চলে। প্রতিটি গাড়িতে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্তা-ড্রাইভার-দালাল সবাই মিলে যদি গড়ে পাঁচ হাজার টাকার দুর্নীতি করে তবে বার্ষিক দুর্নীতির পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে প্রতি বছর কত কোটি টাকার বই বিনামূল্যে দেয়া হয়! আর প্রতিটি বইয়ে যদি মাত্র ১০ টাকার দুর্নীতি হয় তবে মোট টাকার অঙ্ক কত হবে! চট্টগ্রাম বন্দরে, মংলা বন্দরে মোট কত লাখ কনটেইনার আসা-যাওয়া করে, কতটি বাল্ক জাহাজ কিংবা তেলের ট্যাংকার আসে এবং এই খাতে কত টাকার দুর্নীতি হয় তা হিসাব করলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। একইভাবে বিমানবন্দরগুলো ছাড়াও স্থলবন্দরগুলোর দুর্নীতি যোগ করলে সংখ্যাটি মোট জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি বৈ কম হবে না।
আমরা যারা ছোট একটি অফিসে বসে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে গত ৪০ বছর ধরে দুটো ডাল-ভাতের লড়াই সংগ্রাম করছি, লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতির খবর রীতিমতো বজ্রপাতের মতো তাদের শরীর মন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়। আর দুর্নীতির মহারাজাদের ভাবসাব হম্বিতম্বি এবং লম্ফঝম্প দেখলে বেঁচে থাকার আগ্রহ কবরের দিকে দৌড়াতে থাকে।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের দুর্নীতির একটি নতুন আত্মপরিচয় গড়ে উঠেছে। এখানকার দুর্নীতিবাজরা জাহেলিয়াত যুগের মতো বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যাদেরকে আমরা সিন্ডিকেট বলে থাকি। এই সিন্ডিকেটগুলো আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি মারামারি করছে। তাদের মধ্যে জাত-বেজাত, দুর্নীতির বশংবদের ভেদাভেদ। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নিজেদের কুলীন বা উঁচু জাতের দুর্নীতিবাজ ভাবা এবং কারা কতটা দাম্ভিকতার সাথে ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে চলতে পারে তা নিয়ে রীতিমতো হরহামেশা পারস্পরিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। প্রত্যেকটি গ্রুপে রাজা আছে, আছে উজির, সেনাপতি এবং সৈন্য-সামন্ত। তারা ডিম, আলু, তেল থেকে শুরু করে আটা, ময়দা, সুজি এবং ভিক্ষুক থেকে শুরু করে ময়লার বাক্স সর্বত্র সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। কবরস্থান থেকে শুরু করে দেবালয়, ফুটপাথ থেকে শুরু করে রাজপ্রাসাদ! সর্বত্রই সিন্ডিকেটের জয়জয়কার।
বাংলাদেশের সিন্ডিকেটবাজরা খুব ভালো করে বুঝে গেছে, তাদের টিকিটি স্পর্শ করার সাধ সাধ্য স্বপ্ন কারোরই নেই; বরং সিন্ডিকেটবাজদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে অনেকে মহারাজা বা মহারানী হয়ে দুর্নীতির সাগর মন্থন করে দুর্নীতির মাখন দিয়ে সাগরের বুকে হিমালয় বানানোর চেষ্টা করছে। ফলে দেশের কোনো এক প্রান্তের একবিন্দু দুর্নীতি সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে মুহূর্তে স্বর্ণরেণুতে পরিণত হচ্ছে এবং সারা দেশের সেসব স্বর্ণরেণু একত্র হয়ে সিন্ধুতে পরিণত হচ্ছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য