বর্তমানে আমরা এমন সময়ের সাক্ষী হতে চলেছি, যখন আমাদের নবী মুহাম্মদ সা:-এর একেকটি মূল্যবান কথা ও বক্তব্যকে একশ্রেণীর মানুষ মিথ্যা বলার দুঃসাহস করছে। যার ফলে হাদিস অস্বীকার করা কিংবা হাদিসের অপব্যাখ্যা করা আজকাল অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। কখনো ঠুনকো অজুহাতে, কখনোবা নিজ মতের সাথে অমিলের কারণে। কিংবা জোরপূর্বক কোনো একটি হাদিসকে জঈফ-দুর্বল বলে দেয়া হচ্ছে। অথচ একেকটি হাদিস রাসূল সা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, যা সরাসরি সাহাবায়ে কেরাম তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন। সাহাবিদের থেকে তাবেয়ি এবং তাবে-তাবেয়ি হয়ে যুগশ্রেষ্ঠ হাদিসের ইমামদের মাধ্যমে বুখারি-মুসলিম প্রভৃতি গ্রন্থ হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছে। যেগুলো আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে সংরক্ষিত।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, হাদিস আবার দুর্বল হয় কী করে? হাদিস দুর্বল বলতে, উদ্দেশ্য হলো হাদিস বর্ণনাকারী রাবির বিভিন্ন স্তর হিসাবে মুহাদ্দিসদের মানিত ও স্বীকৃত পরিভাষা অনুযায়ী হাদিসের প্রকার নির্ধারণ তথা সহি, হাসান, মুরসাল ইত্যাদি শ্রেণিবিন্যাস। এসব এমন গুরুত্বপূর্ণ নিয়মনীতি, যা উম্মাহর খাইরুল কুরুন তথা সোনালি যুগ থেকে অনুসৃত হয়ে আসছে। মানিত হয়ে আসছে বিশ্ববরেণ্য অ্যাকাডেমিক স্বীকৃত আলেমদের কাছে।
হাদিস অনুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়ি ও মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল, যা আহলে ইলমের অজানা নয়। কিন্তু তাদের এ জাতীয় মতবিরোধ কখনো পরস্পরের মধ্যে মতানৈক্য বা বিশৃঙ্খলার কারণ ছিল না। তখন দলাদলি ও কোন্দল সৃষ্টি হতো না। পরস্পর গালমন্দ ও ঝগড়ার মতো পরিবেশও তৈরি হতো না। তবে এখনকার চিত্র ভিন্ন হচ্ছে।
হাদিসের এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ উসুল ও নীতি না বোঝার কারণে। উলুমুল হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা বা ন্যূনতম ধারণা না থাকায় অনেক বড় আলেম ও শায়েখ থেকেও হাদিস অস্বীকার করার মতো মারাত্মক দুঃসাহস প্রকাশ পাচ্ছে, যা বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। দলাদলি ও কোন্দল হচ্ছে। মুসলমানদের ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। এমনকি হাদিস অস্বীকার করার পরিণতি ইসলাম ত্যাগের মতো ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনতে পারে।
এ জন্য আমরা হাদিস পড়ব ও আমল করব ভালো কথা; কিন্তু হাদিসের ওপর আমল করতে গিয়ে আমাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। একইভাবে একাধিক বর্ণনার হাদিস অনুযায়ী ভিন্ন মাজহাবের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করাও জরুরি। ফিকহে হানাফির অনুসারী হিসেবে আমি একটি হাদিসের ওপর আমল করছি। অন্য কেউ ফিকহে শাফেয়ি, মালেকি বা হাম্বলি মাজহাব ফলো করে এর বিপরীত আমল করতে পারেন। বিপরীত মত থাকতে পারে। তবে তাকে তার আমল থেকে বিরত রাখা, বিপরীত মত তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া- এটা গর্হিত পন্থা। এটি সুন্নাহসম্মত পদ্ধতিও নয়। স্থান কাল পাত্র ভেদেও মাসয়ালার ভিন্নতা হতে পারে। এ কথাটি মানতে হবে। জেনে রাখা ভালো, ফিকহি মতভেদগুলোও এভাবেই তৈরি হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে বিশাল গ্রন্থ আকারে আত্মপ্রকাশ করেছে।
অথচ আমরা এ জাতীয় বিরোধপূর্ণ কাজেই মতভেদ করছি ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, বুঝে না বুঝে। অথবা কারো দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে। কারো ভুল, অপব্যাখ্যা বা আংশিক বক্তব্য শুনে। কাটপিস করা আলোচনা, লেখনী ও বক্তব্য আমাদেরকে আরো বিভ্রান্ত করছে। বিপথগামী হওয়ার পথ খুলে দিচ্ছে।
হাদিস অস্বীকারকারী সম্পর্কে নবীজী সা: ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। মিকদাম বিন মাদি কারিব থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, শোনো! আমাকে কুরআন দান করা হয়েছে এবং এর সাথে এরই মতো (সুন্নাহ) দান করা হয়েছে।
শোনো! সম্ভবত নিজ আসনে বসে থাকা কোনো পরিতৃপ্ত লোক বলবে, ‘তোমরা এই কুরআনের অনুসরণ করো। তাতে যা হালাল পাও, তাই হালাল মনে করো। তাতে যা হারাম পাও, তাই হারাম মনে করো। সাবধান হও! (শুধু কুরআন নয়, সাথে) আল্লাহর রাসূল যা হারাম করেন, তাও আল্লাহ তায়ালার হারাম করার মতোই।’ (সুনানে আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমি) কুরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তিনি (মুহাম্মদ সা:) মনগড়া কোনো কথা বলেন না। আর (যা তিনি বলেন) তা তো ওহি। যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা নাজম : ৩, ৪)
তাফসিরে আহসানুল বয়ানে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়, তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী কী করে হতে পারেন! তিনি তো আল্লাহ তায়ালার প্রত্যাদেশ ছাড়া মুখই খুলতেন না। এমনকি রহস্য ও হাসি-ঠাট্টার সময়ও তাঁর পবিত্র জবান থেকে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হতো না। (সুনানে তিরমিজি)
একইভাবে ক্রোধের সময়ও তাঁর স্বীয় আবেগ ও উত্তেজনার ওপর এত নিয়ন্ত্রণ ছিল যে, তাঁর জবান থেকে কোনো কথা বাস্তবের বিপরীত বের হয়নি। (সুনানে আবু দাউদ)
নবী সা:-এর কোনো কথা ও আদেশ তার প্রবৃত্তি ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে হতো না; বরং আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে বিষয় তাবলিগ-প্রচারের হুকুম করেন তা-ই তিনি মুখ থেকে বের করতেন। সেখান থেকে যা কিছু বলা হয়, সেটিই তার মুখে উচ্চারিত হয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা: থেকে যা কিছু শুনতাম তা-ই লিখে রাখতাম। অতঃপর কুরাইশরা আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করে বলল, তুমি তো রাসূলুল্লাহ সা: থেকে যা শুনছ তার সবই লিখে নিচ্ছ। অথচ তিনি তো একজন মানুষ। তিনি কখনো কখনো ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কিছু বলে ফেলেন! আমি তখন লেখা থেকে বিরত থাকলাম এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলাম। রাসূলুল্লাহ সা: তখন আমাকে বললেন- তুমি আমার কথাগুলো লিখতে থাকো। আল্লাহর শপথ! সত্য কথা ছাড়া আমার মুখ দিয়ে অন্য কোনো কথা বের হয় না। (সুনানে আবু দাউদ ও মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, বিদায় হজের দিন আল্লাহর রাসূল সা: লোকদের মধ্যে খুতবা-বক্তব্য দিলেন। তাতে তিনি বললেন, শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে যে, তোমাদের এই মাটিতে তার উপাসনা হবে; কিন্তু এ ছাড়া তোমরা যেসব কর্মকে অবজ্ঞা করো, সেসব বিষয়ে তার আনুগত্য করা হবে, এ বিষয়ে সে সন্তুষ্ট।
সুতরাং তোমরা সতর্ক থাকবে! অবশ্যই আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি; যদি তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করো, তবে কখনো তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না; আর তা হলো আল্লাহর কিতাব তথা কুরআন এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ তথা হাদিস। (মুসতাদরাকে হাকেম ও সহিহ তারগিব)
অতএব হাদিস তথা সুন্নাহ আমাদের জন্য অবশ্য পালনীয়, যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বরং হাদিস অস্বীকার করার দ্বারা পথভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাই আসুন! হাদিস অস্বীকার করা থেকে সাবধান হই।
লেখক : খতিব, ভবানীপুর মাইজপাড়া হক্কানি জামে মসজিদ, গাজীপুর