শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৬ পূর্বাহ্ন

উত্তাল পদ্মা যেন মরুভূমি: চার দশকে আয়তন কমেছে অর্ধেক

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফারাক্কায় ভারতের বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ছে। এর ফলে ভাটি অ লে পানি প্রবাহ কমতে থাকায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় জনজীবন ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তবে ফারাক্কার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি প্রকট পদ্মা নদীতে। গত চার দশকে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। প্রমত্তা পদ্মা যেন এখন মরুভূমি।
নদী গবেষকরা বলছেন, গঙ্গা চুক্তির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে পদ্মা। পাশাপাশি বিলুপ্ত হয়ে যাবে অর্ধশতাধিক দেশীয় প্রজাতির মাছ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে গঙ্গা নদীতে দেওয়া হয়েছে বাঁধ, যা ফারাক্কা বাঁধ নামে পরিচিত। ১৯৬১ সালে বাঁধের মূল র্নিমাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বরে। ভাটি অ লে হওয়ায় উজানের যে কোনো ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। ফলে নাব্য হারিয়েছে পদ্মা নদী, উত্তাল রূপ এখন ধূসর বালিয়াড়ি। আগে তো পদ্মার এক পাড় থেকে অন্য পাড় দেখা যেত না। এখন পদ্মায় তেমন পানি নেই। অনেক কষ্টে দুই কিলোমিটারের মতো হেঁটে গেলে যে পদ্মা দেখতে পাই এটি আগের পদ্মা নয়। মরা খালের মতো। পদ্মা তীরবর্তীরা বলছেন, সত্তরের দশকে উত্তাল পদ্মার গর্জন ছিল ভয়ঙ্কর। পদ্মর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা যেত না। বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ মিলতো। তবে এখন সবই অতীত।
রাজশাহী নগরীর অলুপট্টি ঘোষপাড়া বড় বটতলায় বসে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব ধিরেন কর্মকার। এসময় জাগো নিউজের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। ধিরেন কর্মকার বলেন, এখানেই এক সময় পদ্মার উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়তো। এখন পদ্মা তো দেখাই যায় না। সেই কোন দূরে চলে গেছে। এখানে বসলে এখন দেখা যায় ধু ধু বালুচর।
তিনি আরও বলেন, আগে তো পদ্মার এক পাড় থেকে অন্য পাড় দেখা যেত না। এখন পদ্মায় তেমন পানি নেই। অনেক কষ্টে দুই কিলোমিটারের মতো হেঁটে গেলে যে পদ্মা দেখতে পাই এটি আগের পদ্মা নয়। মরা খালের মতো। এখান তো পদ্মা পার হতে কিছুই লাগে না, হেঁটে চলে যাওয়া যায়। আমরা যৌবনকালে যে পদ্মা দেখেছি এটা সেই পদ্মা নয়। এখন এই নদী দেখলে কষ্ট লাগে। ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া ২৬ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে পানির প্রবাহ। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে মিঠা পানির সরবরাহ, কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত।
মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন রাজশাহীর শিরামপুরের লিয়াকত আলী।তিনি বলেন, আগে তো পদ্মায় অনেক মাছ হতো। এখন পানিই থাকে না, মাছ কীভাবে আসবে? দিন দিন কমতে কমতে পানি একেবারেই শেষের দিকে চলে যাচ্ছে। আগে শহরের পাশেই মাছ ধরতে পারতাম। এখন মাছ ধরতে হলে নৌকা নামাতেই হেঁটে যেতে হয় দুই কিলোমিটার। এরপর অল্প পানি। কোনোদিন মাছ পাই, কোনোদিন পাই না। এসব কারণে অনেকেই মাছ ধরা বাদ দিয়ে পেশা বদলে ফেলেছেন।
এক নিবন্ধে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানসাময়িকী স্প্রিংগার বলছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া ২৬ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে পানির প্রবাহ। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে মিঠা পানির সরবরাহ, কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত কমেছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ।
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৮ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর প্রবাহ নেমেছে এক লাখ ৮১ হাজার ৫৫০ কিউসেকে। ১৯৯৬ সালের করা ভারত-বাংলাদেশের ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা পয়েন্টে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক পানি থাকলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার, অবশিষ্ট পাবে ভারত। তবে ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক, অবশিষ্ট পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন বলছেন বিশ্লেষকরা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশের নয়টি পয়েন্টে ১২৯ প্রজাতির মাছের অর্ধেকের বেশি অস্তিত্ব সংকটে। একসময় পদ্মায় অনেক শুশুক বা ব্লাক ডলফিন দেখা গেলেও বর্তমানে তা বিলীনের পথে। মৃত পদ্মায় হুমকিতে জলজ উদ্ভিদ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহাম্মদ গালিববলেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশের নয়টি পয়েন্টে ১২৯ প্রজাতির মাছের অর্ধেকের বেশি অস্তিত্ব সংকটে। একসময় পদ্মায় অনেক শুশুক বা ব্লাক ডলফিন দেখা গেলেও বর্তমানে তা বিলীনের পথে। মৃত পদ্মায় হুমকিতে জলজ উদ্ভিদ।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শীতাংশু কুমার পালবলেন, যেভাবে পদ্মার পানি কমছে এতে করে এ অ লের জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। আপনি প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। বর্তমানে সেটাই ঘটছে।
পদ্মায় পানিপ্রবাহ যে হারে কমছে, তা নিয়ে শঙ্কিত নদী গবেষকরা। নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীবলেন, গঙ্গা চুক্তির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে পদ্মা। যৌথ নদী-কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই গবেষক। পদ্মা নদীকে বাঁচাতে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারলে পদ্মা মরুভূমিতে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, নদীমাতৃক এ দেশে সাতশ নদী এবং একশটির অধিক আর্ন্তজাতিক নদীর কথা কাগজে-কলমে রয়েছে। তবে বাস্তবে টিকে আছে কয়টি, এর সঠিক কোনো হিসাব নেই।- জাগো নিউজ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com