রংপুরের ‘হাঁড়িভাঙা’ জাতের আমের সুখ্যাতি এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি এ বছর আম পরিপক্ব হওয়ার আগেই মালয়েশিয়া, নেপাল ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানির জন্য অন্তত ৩০ কোটি টাকার আমের অর্ডার পেয়েছেন বাগান মালিকরা। ভরা মৌসুমে এ অর্ডারের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলেও প্রত্যাশা করছেন তারা। এ বছর আঁশবিহীন সুস্বাদু এই আম বাজারে আসবে ২০ জুন থেকে। কৃষকরা বলছেন, এ মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের বাগানগুলো থেকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার আম বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তারা। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর রংপুরে ১ হাজার ৯৩৫ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩০ হেক্টর বেশি জমি। চাষিরা বলছেন, এবার আমের জন্য আবহাওয়া তেমন একটা অনুকূলে ছিল না। বিশেষ করে দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়া এবং প্রচ- তাপপ্রবাহে ফলন খুব ভালো হয়নি।
এ প্রসঙ্গে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমের ফলন এবার গতবারের তুলনায় কিছুটা কম হয়েছে। তারপরও প্রায় ৩২ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। উৎপাদিত এসব আম বিক্রি ২৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তা জানান, আম চাষি, কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথ বৈঠকে আগামী ২০ জুন বৃহস্পতিবার থেকে এ মৌসুমের হাঁড়িভাঙা তোলার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সব জাতের আমের চেয়ে এটি একটু দেরিতে পরিপক্ব হয়। আম চাষিরাও আনুষ্ঠানিকভাবে ওই তারিখ থেকে আম পাড়া শুরু করবেন। কারণ তখন পরিপক্ব হবে এবং স্বাদও পাবেন ভোক্তারা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩৭ বছর আগে থেকে রংপুরে হাঁড়িভাঙা আম চাষ হচ্ছে। এই আমের বৈশিষ্ট্য হলো আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। ত্বক খুব পাতলা এবং আঁটি ছোট। প্রতিটি আমের ওজন ১৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম হয়। সাধারণত জুনের তৃতীয় সপ্তাহে এই আম বাজারে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় প্রথমে বাণিজ্যিকভাবে হাঁড়িভাঙা আম চাষ শুরু করেন আলহাজ আব্দুস সালাম সরকার। তার সফলতা দেখে ওই এলাকার চাষিরা এই আম চাষ শুরু করেন। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকার মাটি লাল ও কাদাযুক্ত হওয়ায় বছরে একবার ধান ছাড়া কোনও ফসল উৎপাদিত হতো না। সে কারণে এলাকার সবাই হাঁড়িভাঙা আম চাষ শুরু করেন। এর সুনামও ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
বর্তমানে রংপুরের মিঠাপুকুর বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর, পদাগঞ্জ, কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট, সর্দ্দারপাড়া, সদর উপজেলার সদ্যপুস্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি, পাশের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের সব গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান গড়ে উঠেছে। মূলত লালমাটি এলাকায় হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়। আর লালমাটির আম ভীষণ সুস্বাদু।
গত বছর আমের দাম ভালো পাওয়ায় আরও নতুন নতুন আম বাগান গড়ে তুলেছেন এলাকার অনেকে। এই আম বদলে দিয়েছে বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৯০টি গ্রামের মানুষের ভাগ্য। আম চাষ করে এসব গ্রামের অনেক মানুষই স্বাবলম্বী। তবে ক্ষুদ্র চাষিদের অভিযোগ, তারা ন্যায্যমূল্য পান না। আম সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকলে তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে আমের বাগান কিনে নেওয়ায় তারাই (ব্যবসায়ীরা) বেশি লাভবান হচ্ছেন। পদাগঞ্জ ও খোড়াগাছ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় সারি সারি আমের বাগান। এ ছাড়াও প্রতিটি বাড়িতেও দেখা গেলো ১০ থেকে ১৫টি হাঁড়িভাঙা আমের গাছ। সব গাছেই ঝুলে আছে থোকা থোকা আম।
কথা হয় লুৎফর রহমান, শরিফুল ইসলাম, আকলিমা বেগম ও রশিদা সুলতানাসহ এলাকার কয়েকজন আম চাষির সঙ্গে। তারা জানালেন, ৮ থেকে ১০ বছর আগেও এসব এলাকা ছিল দারিদ্র্যপীড়িত। মানুষ একবেলার খাবারও জোটাতে পারতো না। কিন্তু হাঁড়িভাঙা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে। এখন ধানের বদলে ওই জমিতে আমের বাগান গড়ে তুলেছেন তারা। আম বিক্রি করে তারা এখন সচ্ছল হয়েছেন।
হাঁড়িভাঙা আমের সবচেয়ে বড় বাগানের মালিক সোলায়মান আলী জানান, ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন আড়তদার ব্যবসায়ী এবার অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং করেছেন। এসব আড়তদারের মাধ্যমেই আম বিভিন্ন দেশে রফতানি হবে। তার (সোলায়মান) মতো আরও অন্তত ৪০টি বাগান মালিকের সঙ্গে এই ব্যবসায়ীরা চুক্তি করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিদেশে রফতানি হবে, এমন আমের ৩০ কোটি টাকার অর্ডার পাওয়া গেছে। আমরা আশা করছি, এ বছর রফতানি অর্ডার ৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’ একইরকম প্রত্যাশার কথা জানান আহমেদ আলী, মোস্তফা জামানসহ কয়েকজন আমচাষি।
এ বছরই বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম। এ নিয়ে খুশি রংপুর অঞ্চলের চাষিরা। দীর্ঘদিনের এই দাবি পূরণ হওয়ায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন।
এদিকে জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান জানিয়েছেন, সরাসরি বাগান থেকে যাতে আম কিনতে পারেন, সেজন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পাইকারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। আম পাড়া শুরু হলে টাকা লেনদেনের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ খেলা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিও বাড়ানো হবে।
এদিকে আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য নামকরা কুরিয়ার সার্ভিসগুলো পদাগঞ্জ এলাকায় বিশেষ অফিস স্থাপন করছেন। তারা বাগান থেকে আম সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশেষ গাড়িরও ব্যবস্থা করেছেন বলে জানান জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০ জুন থেকে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছি। আম চাষি, কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’