শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৭ পূর্বাহ্ন

‘গরিবদের ব্যাংকার ‘থেকে রক্তচোষা’: নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের দুঃখের কাহিনী

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

টাইম ম্যাগাজিনে চার্লি ক্যাম্পবেলের প্রতিবেদন
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের ১০ মিলিয়নেরও বেশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জামানতবিহীন ঋণে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে। কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস এখনও তার প্রথম ৫ ডলার ধারের কথা মনে রেখেছেন।
সেটি ছিল ১৯৭৪ সাল। ইউনূস মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা ছেড়ে তার জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। যে দেশ মাত্র তিন বছর আগে রক্তে ভেজা গৃহযুদ্ধে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ইউনূস নিজের দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে একটি পদ গ্রহণ করেন। যদিও সেইসময়ে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ এবং প্রতিদিনের প্রবল দারিদ্র্যের কারণে তার দ্রুত মোহভঙ্গ হয়। টাইম-এর সাথে একটি জুম সাক্ষাৎকারে ইউনূস (৮৩) সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, ‘অর্থনীতি একটি অর্থহীন বিষয়। এগুলো শুধু ফাঁকা ধারণা, এটি আমাকে শেখাতে পারেনি কিভাবে দরিদ্র মানুষকে ক্ষুধা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করা যায়।’
ইউনূস তার ক্যাম্পাসের কাছাকাছি গ্রামের অলি-গলি ঘুরে বাস্তব সমাধান খোঁজার চেষ্টা করতেন। এভাবেই একদিন তার চোখে পড়ে গ্রামের এক নারী বাঁশ দিয়ে টুল তৈরি করছেন।যদিও ওই নারী প্রাথমিকভাবে ইউনূসের সঙ্গে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার কাছ ইউনূস জানতে পারেন টুল বানাতে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো কিনতে তিনি ৫ ডলারের মতো ব্যয় করেছেন, যা তিনি লোন হিসেবে নিয়েছিলেন।
কিন্তু তারপরে খোলা বাজারে তার টুল বিক্রি করার পরিবর্তে ঋণের শর্তাবলী তাকে বাধ্য করেছিল ঋণদাতার কাছে তার সমস্ত পরিশ্রমের ফল বিক্রি করতে। এমনকি ঋণদাতা যে দাম চেয়েছিল তাই তাকে দিতে হয়েছিল। ইউনূস মনে করেন ‘এটা দাসত্ব, এটা কোনো ব্যবসা নয়! যা ৫ ডলারের জন্য এমন সুন্দর দক্ষতার মানুষকে দাসে পরিণত করতে পারে।’
ইউনূস ওই নারীকে ৫ ডলার ধার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সক্ষম হলে তবেই তিনি যেন এই ধার পরিশোধ করেন। তিনি ওই নারীর মতো অনুরূপ দুর্দশায় থাকা অন্যান্য গ্রামবাসীকে তার কাছে আসতে বলতে উৎসাহিত করেছিলেন। অবশেষে ৪২ জন নারীর একটি দলকে ২৭ ডলার ধার দেন। সেই সামান্য পদক্ষেপ থেকে একটি ‘মাইক্রোক্রেডিট’ গবেষণা প্রকল্প তৈরি হয়েছিল যার থেকে ১৯৮৩ সালে জন্ম নেয় গ্রামীণ ব্যাংক। ইউনূস যে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পটি শুরু করেছিলেন তা বিশ্বজুড়ে ১০০টিরও বেশি উন্নয়নশীল দেশে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে প্রথম অফিস খোলার পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংক আমেরিকার ৩৫টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রধানত সংখ্যালঘু নারীদের ৪ বিলিয়ন ডলার ধার দিয়েছে। এটি ৯৯% এর উপরে ধারাবাহিকভাবে ঋণ পরিশোধের হার সহ গত বছর ১ বিলিয়ন ঋণ বিতরণ পরিচালনা করেছে।সামগ্রিকভাবে, বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ঋণের ৯৪% এরও বেশি নারীদের কাছে গেছে, যারা দারিদ্র্যের কারণে ভুগছেন এবং পরিবারকে সাহায্য করার জন্য উপার্জন করার কথা ভাবছেন। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা মানুষগুলোর জন্য ইউনূসের এই চিন্তাধারা তাকে ‘গরিবের ব্যাংকার’ করে তুলেছে। গোটা বিশ্ব থেকে প্রশংসার পাশাপাশি ২০০৬ সালে তার ঝুলিতে আসে নোবেল শান্তি পুরস্কার, ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্বাধীনতা পদক এবং এক বছর পরে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল।
তবুও আজ ইউনূস একজন অপরাধী। হোয়াইট হাউসের গোলাপ বাগিচায় ঘুরে বেড়ানোর পরিবর্তে তাকে আজ আক্ষরিক অর্থে ঢাকার কোর্টরুমে বন্দি অবস্থায় দেখা যায়। জানুয়ারিতে, ইউনূস এবং তার টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের অন্য তিন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছয় মাসের কারাদ- দেয়া হয়। যদিও তাদের অবিলম্বে জামিন দেওয়া হয়েছিল, তবুও এটি জালিয়াতি, অর্থ নয়ছয় এবং আত্মসাৎসহ ২০০টিরও বেশি মামলার মধ্যে মাত্র একটি। ইউনূস ক্রমবর্ধমানভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
গত আগস্টে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, প্রাক্তন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন এবং ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৭০ জন বিখ্যাত মানুষ ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘নিরবিচ্ছিন্ন বিচারিক হয়রানি’ বন্ধ করার জন্য শেখ হাসিনাকে আহ্বান জানিয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। জুন মাসে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে, এই মামলাগুলো ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভয় দেখানোর জন্য বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শেখ হাসিনার আচরণকে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকারের বিপর্যস্ত অবস্থার প্রতীক হিসেবে গণ্য করে, যেখানে কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে এবং সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছে। তবুও কিছুই শেখ হাসিনার ক্রোধকে প্রশমিত করতে পারে না, যিনি ২০১১ সাল থেকে ইউনূসকে দরিদ্রদের ‘রক্ত চোষা’ হিসাবে উপহাস করেছেন এবং একই বছর তাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ছেলের বিরুদ্ধে তার ক্রুসেডের নেপথ্যে কি লুকিয়ে আছে ? তা ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন’ বলেছেন ইউনূস। তার মতে, ‘কেউ এর উত্তর জানে না; কিন্তু এটা চলতেই থাকবে।’
সত্যটি বড় জটিল, যেখানে রয়েছে ব্যক্তিগত ঈর্ষা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের এক তীব্র পতন, সেইসাথে একটি স্বতন্ত্র কর্তৃত্ববাদী অঞ্চল জুড়ে আমেরিকান প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। প্রথমত, এটি একটি উন্মুক্ত গোপনীয়তা যা শেখ হাসিনার ঈর্ষার কারণ তা হলো ইউনূসকে বারবার দমন করার চেষ্টা করেও তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছেন। শেখ হাসিনা এই পুরস্কারের জন্য গভীরভাবে আগ্রহী। তিনি মনে মনে বিশ্বাস করেছিলেন যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে আলোচনার জন্য এবং তারপর ২০১৭ সালে প্রতিবেশী মায়ানমারে পালিয়ে আসা এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীকে আশ্রয় দেবার জন্য এটি তার প্রাপ্য ছিল। নরওয়ের নোবেল কমিটি কর্তৃক তার স্বীকৃতির অভাবের জন্য বাংলাদেশের সম্পাদকীয় এবং সরকারি বড় বড় ব্যক্তিরা নিয়মিত শোক প্রকাশ করেন।
আরেকটি মূল বিষয় হচ্ছে, শেখ হাসিনা ইউনূসকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেয়। তিনি সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একইসঙ্গে সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি রাজনৈতিক দল চালু করেছিলেন যা দুর্নীতি ও দুষ্ট মেরুকরণের মোকাবিলা করে প্রশাসনকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। কিন্তু মাত্র ১০ সপ্তাহ পরেই ইউনূস যে কোনও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে বেরিয়ে আসেন। ইউনূস বলছেন, ‘হাসিনা আমাকে রাজনীতিতে আসার জন্য আজও অভিযুক্ত করে চলেছেন, যেন রাজনীতিতে আসাটা অপরাধ।’
যখন ইউনূস তার সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেছিলেন তখন শেখ হাসিনা সামরিক বন্দী ছিলেন, গোটা বিষয়টিকে তিনি চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন তাই কখনই ইউনূসকে ক্ষমা করতে পারেননি। ‘শেখ হাসিনা এটা খুব খারাপভাবে নিয়েছেন যে তাকে রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাই ইউনূসকে অপমান করার, তাকে জেলে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে চলেছেন’- বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী।
তখন থেকেই যখনই কিছু বিশৃঙ্খলা হয় বিশেষ করে পশ্চিমা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বা প্রতিষ্ঠান সেখানে জড়িত থাকে শেখ হাসিনা ইউনূসের দিকে আঙুল তোলেন। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন উৎস দ্বারা প্রমাণিত দুর্নীতির কারণে। (প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় তহবিল দিয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হয়েছিল) হাসিনা বারবার ইউনূসকে গ্রামীণ থেকে জোর করে বের করে দেয়ার প্রতিশোধ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ঋণ আটকে দিতে ইউনূসের অভিজাত সূত্রগুলোকে কাজে লাগানোর অভিযোগ করেছেন। এমনকি ২০২২ সালের মে মাসে তার আওয়ামী লীগের একটি সভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, ইউনূসকে ‘পদ্মায় নিমজ্জিত করা উচিত’। ইউনূসকে আক্রমণ করার কোনো সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি। ২০১২ সালের এপ্রিলে ইউনূস উগান্ডায় সমকামীদের বিচারের সমালোচনা করে অন্য তিনজন নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। এক বছরেরও বেশি সময় পরে বিষয়টিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রচালিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাতিয়ার করে। তারা ইউনূসকে ‘সমকামিতাকে সমর্থন করার জন্য ধর্মত্যাগী’ হিসাবে নিন্দা করে গণ-সমাবেশের আয়োজন করেছিল।
টাইমকে দেয়া সাক্ষাৎকারের মাঝে একটা ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইউনূস বলে ওঠেন, ‘তারা আমাকে একজন ‘সুদখোর’ বলে অভিযুক্ত করেছে। এটি একজন মুসলিম যা করতে পারে তার মধ্যে একটি সবচেয়ে খারাপ কাজ, দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে সুদ নেয়া।’ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি কলঙ্কিত হয়েছে। অসাধু অপারেটররা দ্রুত আবির্ভূত হয়ে ‘মাইক্রোক্রেডিট’কে প্রথাগত লাভজনক ঋণদান পরিষেবাগুলোতে পরিণত করতে প্রচুর স্কিম এবং নেতিবাচক কভারেজ তৈরি করেছে। ইউনূস দীর্ঘকাল ধরে লাভজনক স্কিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। ইউনূস বলেছেন, ‘আইপিও-এর উদ্দেশ্য হলো লোকদের জানানো যে, আপনি দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এটি লোন-শার্কিং মাইক্রোক্রেডিট।’
আজ, শেখ হাসিনা ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে স্পষ্টবাদী সমালোচকদের একজন। কিন্তু ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইউনূস ওয়াশিংটন ডিসি-তে একটি মাইক্রোক্রেডিট সামিটের আয়োজন করেছিলেন যেখানে হাসিনা সহ-সভাপতি ছিলেন। তার বক্তব্যে, হাসিনা ইউনূসের কাজের প্রশংসা করেন এবং পৃথিবীর বুক থেকে সামগ্রিক দারিদ্র্য হ্রাস ও নির্মূল করার প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে ক্ষুদ্রঋণ সম্প্রসারণের আহ্বান জানান। ইউনূস ছিলেন হাসিনার পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের কট্টর সমর্থক। টেনেসিতে শিক্ষকতা করার সময় ইউনূস একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র পরিচালনা করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে একটি নিউজলেটার প্রকাশ করেন।শেখ মুজিব যদি জানতেন তাহলে তার মেয়ের প্রতিহিংসার কথা শুনে কী করতেন ? জানতে চাইলে ইউনূস বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে তিনি বিরক্ত হতেন।’
নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক কয়েক দশক ধরে হাসিনার রাজনৈতিক গতিপথে- যার মধ্যে রয়েছে সামরিক হস্তক্ষেপ এক ডজনেরও বেশি গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা এবং নিয়মিত রাজনৈতিক রক্তপাতের ঘটনা- তাকে কঠোর করেছে, ব্যক্তিগত অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তার শাসনের বিগত ১৫ বছরে তিনি রাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত যন্ত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন, সবচেয়ে লক্ষণীয়ভাবে বিচার বিভাগ। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়া প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো ‘বিচারিক হয়রানি’। কয়েকদিনের মধ্যে তাকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং তার জীবনের হুমকির কারণে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে তার পরিবারের সঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে আত্মগোপন করে রাখা হয়।
ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাংলাদেশের অবনতিশীল সম্পর্কও সম্ভবত ইউনূসের দুর্দশায় অবদান রাখছে। আন্তর্জাতিকভাবে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বিখ্যাত বাংলাদেশি ইউনূস যিনি বলেছেন যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে একজন ‘বন্ধু’ হিসাবে গণ্য করেন। আসলে ইউনূস ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাঝে পড়ে গেছেন। বাংলাদেশে মানবাধিকারের অবনতিশীল চিত্রের মধ্যে যেখানে লক্ষাধিক বিরোধী কর্মী রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে এবং ২০০৯-২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ২৫০০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের অভিযোগ উঠেছে, হাসিনাকে বাইডেন প্রশাসনের সর্বশেষ দুটি সামিট ফর ডেমোক্রেসি সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গত বছরের মে মাসে ওয়াশিংটন জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনকে ক্ষুণ্ন করে এমন যেকোনো বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করে। জবাবে, হাসিনা সংসদে বলেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ‘গণতন্ত্রকে দূর করার চেষ্টা করছে’।
হাসিনা আমেরিকার চাপে পড়ে নড়বড়ে হননি বরং বিরোধীদের দ্বারা বয়কট করা ব্যালটে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন বা ন্যায্য নয় বলে এই নির্বাচনের নিন্দা করেছে। তবুও নতুন ম্যান্ডেট হাসিনাকে উৎসাহিত করেছে। একটা ধারণা আছে যে, যখনই যুক্তরাষ্ট্র হাসিনার ওপর মূল্য আরোপ করে, ইউনূস একটি সুবিধাজনক বেত্রাঘাতকারী ছেলে হিসাবে কাজ করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, কিছুটা হলেও ইউনূস নিজের বিছানা নিজে তৈরি করেছেন।মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল না উঠিয়ে ইউনূস নীরব থেকেছেন, প্রকাশ্যে হাসিনার নিন্দা বা কথা বলতে অস্বীকার করেছেন। আজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইউনূসের খুব কম বন্ধু আছে এবং বিদেশে তার বন্ধুদের প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৮ সালে, স্পষ্টভাষী বাংলাদেশী ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমকে সরকারের সমালোচনা করার পরে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তখন জনসাধারণের ক্ষোভ এতটাই উগ্র ছিল যে কর্তৃপক্ষ তাকে ১০৭ দিন পরে জামিনে মুক্তি দেওয়ার জন্য রীতিমতো চাপ অনুভব করেছিল।’ সেখানে ইউনূসের দুর্দশার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মাত্র ৫-১০% মানুষ। গুটিকয়েক সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের মানুষ ছাড়া আর কেউ তার পেছনে নেই। তিনি বাংলাদেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছেন- বলেছেন নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংলাদেশি প-িত মুবাশার হাসান।
হাসান, যিনি নিজে ২০১৭ সালে একটি গোপন সামরিক কারাগারে ৪৪ দিনের জন্য বিচারবহির্ভূত বন্দী ছিলেন তিনি বলেছেন, ইউনূস তার অতুলনীয় বৈশ্বিক প্রোফাইল ব্যবহার করে বাংলাদেশের অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করতে পারতেন। জানুয়ারীতে তার বিরুদ্ধে আদালতের রায়ের পরে তিনি মুখ খুলতে শুরু করেন। হাসানের মতে, ‘ইউনূস ভেবেছিলেন যে, তার প্রভাবশালী সংযোগগুলো হয়তো সুরক্ষা হিসাবে কাজ করবে। তিনি ভুল হিসাব করেছেন। কারণ ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে সরকার অনেক বেশি আস্থা অর্জন করেছে। নিজেকে অস্পৃশ্য রাখার ইউনূসের উপলব্ধি ব্যাকফায়ার হিসেবে কাজ করেছে।’
ইউনূস জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন। যদিও আজ তিনি দেখছেন তার ভাগ্য স্বদেশীদের সাথে জড়িয়ে যাদের তিনি আজীবন সাহায্য করে গেছেন । বিদেশে আরামদায়ক পদের অফার থাকা সত্ত্বেও, তিনি তার নামের ওপর থেকে বদনাম সরাতে বাংলাদেশে থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-এমনকি যদি এর অর্থ জেলও হয় তাহলেও তিনি পিছপা হতে রাজি নন। নোবেলজয়ী ইউনূসের কথায়, ‘আমি জেলের সাজা এড়াতে চাই বলেই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারি না। কারণ এটা আমার সারাজীবনের কাজ। যে মুহূর্তে আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মনে হয়েছে এই শিকড় ছিঁড়ে যাবে।’ (অনুবাদ: সেবন্তী ভট্টাচার্য্য)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com