যে কোনো বিপ্লব তার নাটকীয় উত্থান, আবেগ এবং রূপান্তরের মাধ্যমে প্রায়শই জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতিও অনেকটা ভূমিকম্পের মতোই । তার পদত্যাগ-হিংসাত্মক বিক্ষোভ এবং জনসাধারণের অস্থিরতার পটভূমিতে শুধুমাত্র একটি নিপীড়িত জনগণের ক্ষোভকেই হাইলাইট করেনি বরং একটি বিশৃঙ্খল পরিণতির উপরও আলোকপাত করেছে। যার পরিণতি ‘শাসনের পতন’। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া শেখ হাসিনার শাসনামলে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। সেই সঙ্গে কর্তৃত্ববাদ এবং দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠেছে। বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল সরকারি চাকরির জন্য একটি বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি নিয়ে। এই অস্থিরতায় ইন্ধন যোগায় সরকারবিরোধী দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভ। যা এই বিক্ষোভকে সংঘর্ষের দিকে পরিচালিত করে এবং ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এই ধরনের বিপ্লবগুলোকে শ্রেণি সংগ্রাম এবং অসাম্যের অনিবার্য পরিণতি হিসাবে দেখেছিলেন। অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক অবিচার দ্বারা চালিত প্রতিবাদগুলো এই দৃষ্টিকোণকে প্রতিফলিত করে। অনেক যন্ত্রণায় উদ্দীপিত জনসাধারণের সম্মিলিত পদক্ষেপ তাই একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে সমতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাসনকে প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টা।
হাজার হাজার বিক্ষোভকারী হাসিনার সরকারি বাসভবনে হামলা চালায়, মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। সর্বত্র অনাচার ও নৈরাজ্যের দৃশ্য ফুটে ওঠে। জন লকের মতো দার্শনিকরা দীর্ঘকাল ধরে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিপ্লবগুলো ন্যায্য হয় যখন সরকার তাদের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।লকের সামাজিক তত্ত্ব বলে যে, সরকারি দায়িত্ব লঙ্ঘন জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়, তাদের বিদ্রোহকে বৈধ করে তোলে। এই তত্ত্ব বাংলাদেশের মাটিতে স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে, যেখানে জনগণ বিশ্বাসঘাতকতা ও নিপীড়িত বোধ করে। প্রতিবাদের মাধ্যমে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের নেতার নাটকীয় বহিষ্কারের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার পুনরুদ্ধার করে। হাসিনার পদত্যাগের পরপরই বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তার সরকারি বাসভবন গণভবন ভাঙচুর করা হয়। বিক্ষোভকারীরা আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স, এমনকি পশুপাখি লুট করে নিয়ে চলে যায় । বিশৃঙ্খলার এই দৃশ্যগুলো ঐতিহাসিক বিপ্লবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে জনসাধারণের প্রাথমিক বিজয়কে প্রায়শই অনাচারে পরিণত হতে দেখা গেছে। অশান্তির এই পর্যায়টি মানব প্রকৃতি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে টমাস হবসের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হবস বিশ্বাস করতেন যে, একটি শক্তিশালী কর্তৃত্ববাদী শাসকের অনুপস্থিতিতে, সমাজে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই নৈরাজ্য এবং সহিংসতা নেমে আসবে। ঢাকায় লুটপাট ও ভাঙচুর এই হবসিয়ান দুঃস্বপ্নের উপর আলোকপাত করে যেখানে একটি শাসনের উৎখাতে সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায় আইনের শাসন।
সামরিক বাহিনীর ২৪-ঘণ্টা বিলম্ব: এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিকভাবে হাসিনার শাসনামল থেকে সামরিক বাহিনী তার কর্তৃত্ব লাভ করে। যখন তিনি পদত্যাগ করেন তাদের বৈধতা অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সামরিক বাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের কাছে যায়, যিনি তাদের একটি অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের আদেশ দেন।তাদের বৈধতা পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে এই বিলম্ব একটি বড় প্রশ্নের উদ্রেক করে, কেন লুটপাট বন্ধ করতে তারা অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করেনি ? কেন বিক্ষোভকারীদের পরিস্থিতি নিয়ে খেলার সুযোগ করে দেয়? সামরিক বাহিনীর সংযমকে আরও উত্তেজনা এড়ানোর একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসাবেও দেখা যেতে পারে। তারা জনগণের প্রতি সমর্থন বজায় রাখতে চেয়েছে যারা সবেমাত্র একটি বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে। ২৪-ঘণ্টা সময়ের মধ্যে স্থানীয় এবং জাতীয় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীও কার্যত অদৃশ্য থেকেছে। কারণ হাসিনার আমলে জনসাধারণ এবং রাষ্ট্র-চালিত নিরাপত্তা বাহিনীর (বিশেষ করে পুলিশ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) মধ্যে সম্পর্ক বিশেষভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।
প্রতিশোধমূলক সহিংসতা: প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বিপ্লবের একটি সাধারণ পরিণতি যা প্রায়শই বিক্ষুব্ধ জনতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। হাসিনার নিরঙ্কুশ শাসনামলে অনবরত অন্যায় এবং অবিচার সম্ভবত প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষাকে উস্কে দিয়েছিল। লোকেরা কেবল রাজনৈতিক নিপীড়নের জন্য নয় বরং তাদের পরিবার বা বন্ধুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্যও প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।
সহযোগীদের বহিষ্কার: অত্যাচারী শাসনের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত বিদেশি শক্তিগুলোকে বহিষ্কারের বিষয়টিও দৃশ্যপটে এসেছে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে। তাই এই বৈপ্লবিক কর্মকা- সেইসব বিদেশি অনুঘটকের বিরুদ্ধেও কাজ করেছে। কল্পনা: বিপ্লবের পরে জনগণের মধ্যে দেখা দেয় ভয়। ছড়িয়ে পরে ভুল তথ্য। নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব জনগণকে সবচেয়ে খারাপ কল্পনার দিকে নিয়ে যায়। যার ফলে বিপ্লবোত্তর একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং উচ্চতর উদ্বেগের পরিবেশ তৈরি হয়। লুকানো এজেন্ডাগুলো মানুষের মনে উদ্বেগের পাশাপাশি ষড়যন্ত্র তত্ত্বেরও জন্ম দেয়।
ক্রান্তিকাল: বিপ্লব-পরবর্তী সময়টি অনেক চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। একটি পুরনো শাসনের বিলুপ্তি প্রায়ই ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি করে। যা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ফায়দা তোলার চেষ্টা করে, তৈরি হয় অস্থির পরিবেশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের জন্য সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি এই ক্রান্তিকালীন পর্যায়ে সেতুর মতো মনে হতে পারে, কিন্তু দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এখনো অনেকাংশে অনিশ্চিত। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে ফরাসি বিপ্লব আমাদের দেখিয়েছে বিপ্লব থেকে স্থিতিশীল শাসনের পথ বিপজ্জনক এবং আরও সংঘাতের সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। সামনের পথ: শেখ হাসিনার পতন এবং দেশে পরবর্তী বিশৃঙ্খলা বিপ্লবের জটিল গতিপ্রকৃতির দিকে ইঙ্গিত দেয়।এগুলোর জন্ম হয় নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত ক্রোধ থেকে, যা তাদের চাহিদা পূরণে সরকারি ব্যবস্থার ব্যর্থতা থেকে উদ্ভুত হয়। পরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও অনাচার এই ধরনের উত্থান-পতনের অন্তর্নিহিত ঝুঁকিগুলোকে তুলে ধরে। অন্যদিকে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দেয়। সবশেষে ইতিহাস আমাদের একটা কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। বিপ্লবের আসল লক্ষ্য পুরনো শাসনের উৎখাত নয়, বরং অনাচারকে দূরে সরিয়ে রেখে একটি ন্যায়সম্মত ও স্থিতিশীল নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
লেখক: যুক্তরাজ্যের নর্থামব্রিয়া ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি এবং ক্রিমিনাল জাস্টিসের একজন সহকারী অধ্যাপক।