আপনি কি কখনও এমন অবস্থায় পড়েছেন যেখানে আপনি কারও নাম বা কোনো জায়গার নাম মনে করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না? অনেকেই বলে থাকেন যে বয়সের সাথে সাথে আমাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। এমনকি যুক্তি দেয়ার সক্ষমতাও কমে আসে। তবে আশার কথা হচ্ছে, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা যায়। কিছু মানসিক চর্চা আর কৌশলের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে আবার শানিয়ে নেয়া সম্ভব।
১. ব্যায়াম: এটা আসলেই সত্যি আমরা শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করলে আমাদের মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটে। ব্যায়ামের কারণে মস্তিষ্কের সাইন্যাপসিস বা যে অংশে দু’টি কোষের নিউরনের মধ্যে স্নায়বিক বৈদ্যুতিক স্পন্দন আদান-প্রদান ঘটে তা বেড়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কে আরো বেশি যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং অতিরিক্ত কোষ গঠিত হয়।
হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকার মানে হচ্ছে আপনি আরো বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারবেন এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে পারবেন।
আর আপনি যদি বাসার বাইরে বা খোলা যায়গায় শরীর চর্চা করেন তাহলে সেটি আরো বেশি ভালো। কারণ এতে করে আপনি বেশি পরিমাণে ভিটামিন ডি শোষণ করতে পারবেন।
ব্যায়াম করার সময় নতুন কোনো পরিবেশ ঘুরে দেখুন। এতে অন্য মানুষের সাথে মতামত বিনিময় করা কিংবা তাদের কাছ থেকে নতুন কিছু শেখার সুযোগ হয়। এর মাধ্যমে নতুন কোষগুলোর জন্য আপনি একটি সার্কিট তৈরি করতে পারবেন।
যেমন, আপনি যদি বাগান করতে পছন্দ করেন, তাহলে একা বাগান না করে কোনো একটি গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে বাগান করতে শুরু করুন কিংবা আপনার যে শখটি আছে তা একা একা না করে একই শখ রয়েছে এমন একটি গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে যান। এতে নতুন বন্ধু তৈরি হবে।
শুধু মনে রাখবেন, আপনাকে একটি ভালো সময় কাটাতে হবে। কোন কিছু শেয়ার করার ইচ্ছা বা ভাগাভাগি করার ইচ্ছা মস্তিষ্কে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া ও ব্যায়ামের উপকারিতা বাড়িয়ে দেয়।
২. চলতি পথে মুখস্থ করা: চলতি পথে মুখস্থ করার অভ্যাস বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত এবং অভিনেতারা এই বিষয়টির চর্চা করেন। বলা হয় যে, আপনি চলার পথে যদি নতুন কোনো শব্দ বা নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেন তাহলে সেটি বেশি মনে থাকে।
ভবিষ্যতে যদি আপনাকে কোনো প্রেজেন্টেশন বা কোনো বক্তব্য দিতে হয় তাহলে আপনি হাঁটতে হাঁটতে সেটি পড়ে দেখতে পারেন। এমনকি মস্তিষ্ককে মনে রাখতে সাহায্য করতে নাচানাচিও করে দেখতে পারেন।
৩. সঠিক খাবার খান: আপনি যে পরিমাণ শক্তি ও গ্লুকোজ গ্রহণ করেন তার ২০ শতাংশ সরাসরি আপনার মস্তিষ্কে যায়। এ কারণে আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে দেহের গ্লুকোজের পরিমাণের উপর।
আপনার দেহের গ্লুকোজের মাত্রা যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে আপনার মন ও মস্তিষ্ক অনেকটাই কুয়াশাচ্ছন্ন বা ঝাপসা মনে হতে পারে। আমরা যখন পছন্দের খাবার খাই তখন আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে এক ধরনের রাসায়নিক নির্গত হয়। এর কারণে আমরা খাওয়ার সময় শান্তি অনুভব করি।
কিন্তু শুধু মস্তিষ্কের ক্ষুধা মেটালেই চলে না, পেটের ক্ষুধাও মেটানো দরকার। মানুষের পরিপাকতন্ত্রে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন অণুজীব থাকে। এরা স্নায়ু ব্যবস্থার মাধ্যমে মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত থাকে। আর তাই মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে হলে এসব অণুজীবের একটা ভারসাম্য রাখতে হয়। পেটকে বলা যায় ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’। স্বাস্থ্যকর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার এসব অণুজীবের মাত্রা ঠিক রাখে এবং মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখে।
মস্তিষ্কের কোষ চর্বি দিয়ে গঠিত। তাই খাবার থেকে চর্বি একেবারে বাদ দেয়াটা ঠিক নয়। বিভিন্ন রকমের বাদাম, বীজ, অ্যাভোকাডো, মাছ, রোজমেরি ও হলুদ থেকে প্রাপ্ত ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের জন্য ভালো।
একই সাথে একা একা না খেয়ে অনেকের সাথে মিলে খাওয়ার চেষ্টা করুন। সামাজিকীকরণ আপনার মস্তিষ্কে স্বাস্থ্যকর খাবারের সুফল বাড়িয়ে দেয়।
৪. বিরতি নিন: কিছু চাপ বা স্ট্রেস থাকাটা সবসময়ই দরকার কারণ এটি আমাদের জরুরি অবস্থায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে সহায়তা করে। এটি কর্টিসল নামে এক ধরনের হরমোনের নিঃসরণকে সহায়তা করে যা সাময়িকভাবে আমাদেরকে উজ্জীবিত করে এবং কোনো কিছুর উপর মনোযোগ দিতে সাহায্য করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা এবং অতিমাত্রায় অস্বস্তিকর চাপ আমাদের মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর।
আর এ কারণেই সময় মতো বিরতি নেয়া এবং আমাদের মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়াটা জরুরি। তাই সবকিছু থেকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরতি নেয়ার অর্থ হচ্ছে, আপনি আপনার মস্তিষ্কের ভিন্ন একটি অংশ ব্যবহার করছেন।
আমাদের মস্তিষ্কে স্বাভাবিকভাবে একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক থাকে যার কাজ হচ্ছে মানুষকে কল্পনা করার ক্ষমতা বা দিবাস্বপ্ন দেখার সক্ষমতা দেয়া। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরতি নেয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের এই অংশকে সক্রিয় করি এবং সেটিকে কাজ করার সুযোগ করে দিই।
যদি আপনার সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং মস্তিষ্ককে শান্ত করাটা কঠিন মনে হয়, তাহলে ধ্যান করার মতো কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখতে পারেন। ধ্যান স্ট্রেস হরমোনের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে।
৫. নতুন চ্যালেঞ্জ নিন: মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানোর একটি ভালো উপায় হচ্ছে একে কোনো একটা চ্যালেঞ্জ দেয়া, যেমন, নতুন কিছু শেখা। আর্ট ক্লাসে অংশ নেয়া কিংবা নতুন কোনো ভাষা শেখার মতো কাজ আপনার মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়।
এর অংশ হিসেবে আপনি আপনার পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে মিলে কোনো একটি অনলাইন গেম শুরু করতে পারেন। এটা শুধু আপনার জন্য একটা চ্যালেঞ্জই হবে না; অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতার মানে হচ্ছে আপনার সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া বাড়বে। আর সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাটা মস্তিষ্কের সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৬. গান শুনুন: সঙ্গীত মস্তিষ্ককে অসাধারণ উপায়ে উদ্দীপিত করে। আপনি যদি গান শোনার সময় কিংবা বাদ্য যন্ত্র বাজানোর সময় কারও মস্তিষ্কের চিত্র দেখেন তাহলে দেখবেন যে তার মস্তিষ্কের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।গান সাধারণ বোধশক্তি ও স্মৃতিকে শক্তিশালী করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীরাও সবার শেষে যা ভুলে যায় তা হচ্ছে গান। তাই নিজে গান করুন বা গান শুনুন।
৭. পড়া এবং ঘুম: আপনি যদি দিনের বেলায় নতুন পড়েন তাহলে, আপনার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে এক ধরনের সংযোগ স্থাপিত হয়। আর আপনি যখন ঘুমিয়ে যান তখন ওই সংযোগ শক্তিশালী হয় এবং আপনি যা শিখেছেন তা স্মৃতিতে পরিণত হয়।
এ কারণে স্মৃতির জন্য ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণে আপনি যদি কাউকে ঘুমানের আগে কোনো কিছু মুখস্থ করতে দেন তাহলে কারা পরের দিন সকালেও সেটি আরো ভালোভাবে মনে করতে পারবেন। কিন্তু কাউকে যদি আপনি সকালে কোনো কিছু মুখস্থ করতে দেন এবং সন্ধ্যায় সেটি মনে করতে বলেন তাহলে তারা সেটি তেমন ভালোভাবে মনে করতে পারবে না।
তাই আপনি যদি কোনো পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন তাহলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রশ্নের উত্তরগুলো মাথায় একবার ঝালিয়ে নিন।
আর আপনি যদি কোনো বেদনাদায়ক ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন তাহলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সেটি মনে করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ তাহলে এটি আপনার ওই স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে এবং এ সম্পর্কিত নেতিবাচক আবেগ বাড়তে পারে।
একই কারণে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভয়ঙ্কর মুভি কিংবা গল্প শোনা থেকে বিরত থাকুন। এর পরিবর্তে দিনের বেলায় আপনি যেসব ভাল বা সুখকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেগুলো মনে করার চেষ্টা করুন। যাতে করে আপনার মস্তিষ্ক ওই ভাল স্মৃতিতে আটকে থাকে।
৮. ভালোভাবে জেগে উঠুন: ঘুম যেমন স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আপনি কীভাবে ঘুম থেকে জেগে উঠছেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনি দিনের বেলায় কতটা সচেতন ও চাঙ্গা থাকবেন তা নির্ভর করবে আপনি কীভাবে ঘুম থেকে জেগে উঠছেন তার উপর।
সাধারণত অন্ধকার ঘরে ঘুমানো উচিত এবং আলো বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে জেগে উঠা উচিত। সাধারণত ভোর বেলা এ ধরণের পরিস্থিতি থাকে। সূর্যের আলো বন্ধ চোখের পাতার ভেতর দিয়ে গিয়ে মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করে জেগে উঠার জন্য। যাতে করে কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ পর্যাপ্ত হয়। কারণ আপনার দেহে এই হরমোনের মাত্রাই ঠিক করে যে আপনার মস্তিষ্ক সারাদিন কতটা কার্যক্ষম থাকবে।
এক্ষেত্রে আপনি এমন একটি অ্যালার্ম সিস্টেম কিনতে পারেন যেটি ভোর হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে বা ধীরে ধীরে আলো বাড়ায় এবং আপনি স্বাভাবিকভাবেই জেগে উঠতে পারেন। আর যাদের ঘুম অনেক গভীর হয় তারা এই আলোর সাথে যাতে শব্দ থাকে সেটিও খেয়াল রাখুন।