শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৮ পূর্বাহ্ন

ইসলামের দৃষ্টিতে সৈনিকের মর্যাদা

প্রফেসর কর্নেল ডা: জেহাদ খান (অব:)
  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৪

ইসলামের সাথে তুলনার জন্য অন্যান্য ধর্মের দৃষ্টিতে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও সামরিক নীতি সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। পৃথিবীর বড় বড় ধর্মের মধ্যে খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম যুদ্ধ করার বিপক্ষে, তা যেকোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হোক না কেন। ইহুদি, হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়। হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ বেদে যুদ্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক শ্লোক রয়েছে, যেমন-‘মহাশক্তিমান ইন্দ্র রাজা নিজের গৌরবর্ণের (আক্রমণকারী আর্য) বন্ধুদের সহযোগে ভূমি জয় করলেন, সূর্যের কিরণ এবং সাগর জয় করলেন। হে ইন্দ্র, আমাদের সহায় থাক যেন আমরা নির্ভয়ে সম্পদ লুটতে পারি। (ঋগে¦দ ১৩০:৪৮) এভাবে ৪টি বেদে যুদ্ধের অনেক শ্লোক রয়েছে যা থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিনদেশের জমি, সম্পদ, জীব-জন্তু ইত্যাদি দখল করা।
ইহুদি ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ তাওরাত পাঠ করলে জানা যায় যে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য রাজ্য জয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের সমরনীতি আরো ভয়ঙ্কর, যেমন- ‘আমরা প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশুকে প্রত্যেক শহরে হাসুবুনের রাজা সাইহুন ও তার জাতীর লোকদের মতোই হত্যা করলাম। (তাওরাত ৩:১-৭)। বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনিদের সাথে ইহুদিদের আচরণে এ মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও যুদ্ধনীতির অনেক উল্লেখ রয়েছে কুরআন ও হাদিসে, যেমন- ‘আর তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না, অথচ দুর্বল পুরুষ নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমার রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী। (কুরআন ৪:৭৫)। ‘তাদেরকে অনুমতি দেয়া হলো যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, কেননা তারা নির্যাতিত। আল্লাহ নিশ্চিতই তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। (কুরআন ২২:৩৯) এভাবে কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে যা থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যায়কে প্রতিহত করা, অন্যের সম্পদ দখল নয়।
যুদ্ধে যাওয়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের সেবা ও তত্ত্বাবধান করাকে ওই ব্যক্তির কাজের সমান মনে করে নিয়েছ যে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি এবং প্রাণান্ত করল আল্লাহর পথে। (কুরআন ৯:১৯)
একটি মুসলিম দেশের স্বাধীনতা যখন বিপন্ন হয় বা এর নিরাপত্তা হুমকির মুখে, তখন তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা আল্লাহর দৃষ্টিতে অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর নির্ভরশীল। ‘তোমরা বের হয়ে পড়ো, হালকাভাবে ও ভারী উভয় অবস্থায় এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করো তোমাদের মাল ও জান নিয়ে। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।’ (কুরআন ৯:৪১)
যুদ্ধে বের না হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ সতর্ক করছেন- ‘তোমরা যদি যুদ্ধের জন্য বের না হও তাহলে তোমাদেরকে পীড়াদায়ক শাস্তি দান করা হবে এবং তোমাদের স্থলে অপর কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। (কুরআন ৯:৩৯)
যুদ্ধের প্রস্তুতি : একটি দেশের যদি যুদ্ধ প্রস্তুতি বা যুদ্ধের সক্ষমতা না থাকে তাহলে বহিঃশত্রুকে তা দখলে প্রলুব্ধ করে। এজন্য পৃথিবীর বেশির ভাগ উন্নত দেশে সামরিক প্রশিক্ষণকে প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন- ‘আর তোমরা যতদূর সম্ভব বেশি পরিমাণ শক্তিমত্তা ও সদাসজ্জিত ঘোড়া তাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করে রেখো, যেন এর সাহায্যে আল্লাহর এবং নিজেদের দুশমনদের আর অন্যান্য এমন সব শত্রুদের ভীত-শঙ্কিত করতে পার যাদেরকে তোমরা জানো না কিন্তু আল্লাহ জানেন। (কুরআন ৮:৬০)
এখানে যুদ্ধ প্রস্তুতি বলতে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র, যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ জাহাজ ইত্যাদি জোগাড় করা এবং তৈরি করা বোঝায়। যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাইরের আমদানি করা অস্ত্র দিয়ে বেশি দিন যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।
রাসূল সা: আসলাম গোত্রের একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা তীরন্দাজি চর্চা করছিল। তিনি বললেন, হে বানু ইসমাইল! তোমরা তীর নিক্ষেপ করতে থাক। কেননা তোমাদের পূর্বপুরুষ দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন এবং আমি ‘অমুক’ গোত্রের সাথে আছি। (বুখারি)। আয়েশা রা: বলেন, ঈদের দিনে হাবশি লোকেরা ঢাল ও বর্শা নিয়ে খেলা করত। (বুখারি)। ইবনে উমার রা: বলেন, রাসূল সা: হাফইয়া থেকে সানিয়াতুল বিদা পর্যন্ত সীমানার মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়াসমূহের দৌড় প্রতিযোগিতা করিয়েছেন। (বুখারি)
মনোবল : যুদ্ধে মনোবল অস্ত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সা: ও তার খলিফারা শত্রুর তুলনায় জনবল ও যুদ্ধাস্ত্র কম থাকা সত্ত্বেও শুধু মনোবলের কারণে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। মহান আল্লাহ মনোবল প্রসঙ্গে বলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যদি একশত লোক ধৈর্যশীল হয়, তবে তারা দু’শয়ের ওপর আর এক হাজার লোক এরূপ হলে দু’হাজার লোকের ওপর আল্লাহর হুকুমে বিজয়ী হবে। আল্লাহ কেবল সে লোকদের সঙ্গী হন যারা ধৈর্য ধারণকারী। ‘(কুরআন ৮:৬৬)। ‘যারা দৃঢ় ধারণা রাখত যে, তারা আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, তারা বলল, ‘কত ছোট দল আল্লাহর হুকুমে বড় দলকে পরাজিত করেছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ (কুরআন ২:২৪৯)। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উদাহরণ আছে যে বৃহৎ পরাশক্তি বা আ লিক পরাশক্তি যুদ্ধ বিমান, ট্যাংক, কামান, ড্রোন ইত্যাদি থাকার পরও স্বাধীনতাকামীদের সাথে সম্মুখ সমরে ক্ষুদ্রাস্ত্র ও তাদের মনোবলের কারণে পিছু হটেছে।
দুনিয়ার মোহ ও মৃত্যুভীতি সৈনিকদের মনোবল তৈরিতে বাধাস্বরূপ :‘অতঃপর তাদের ওপর যখন লড়াই ফরজ করা হলো, তখন তাদের একাংশ অন্য লোকদের ভয় করতে লাগল, যেরকম ভয় আল্লাহকে করা উচিত। তাদেরকে বল, দুনিয়ার সুখ সামান্য। আর যে তাকওয়া অবলম্বন করে তার জন্য আখিরাত উত্তম। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের জন্য অবধারিত যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। ‘(কুরআন ৪:৭৭-৭৮)
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য : ইসলামে নেতার আনুগত্যকে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের সমান জরুরি বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং নেতার অবাধ্যতার পরিণতি আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতার সমান বলা হয়েছে।
‘হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। ‘(কুরআন ৪:৫৯)। ইবনে ছামিত রা: বলেন, আমরা নি¤েœর কাজগুলোর জন্য রাসূলের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলাম : ১. নেতার আদেশ শুনতে হবে তা দুঃসময়েই হোক বা সুসময়েই হোক। ২. নিজের তুলনায় অপরের সুযোগ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ৩. আমির বা নেতার সাথে বিতর্কে জড়াব না, তবে নেতার আদেশ প্রকাশ্য কুফরির শামিল হলে ভিন্ন কথা। (বুখারি, মুসলিম)
রসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করল, সে আল্লাহ তায়ালারই নাফরমানি করল। আর যে ব্যক্তি আমিরের আনুগত্য করল সে আমারই আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি আমিরের নাফরমানি করল সে আমারই নাফরমানি করল। (বুখারি)
তবে এ আনুগত্য শর্তহীন নয়। রাসূল সা: বলেন, গুনাহের কাজে নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নেতার আদেশ শোনা এবং আনুগত্য করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্য কর্তব্য। (বুখারি) একে আধুনিক সামরিক পরিভাষায় বলা হয় খধভিঁষ ঈড়সসধহফ বা বৈধ আদেশ। অর্থাৎ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ যদি টহষধভিঁষ হয় বা আইনের পরিপন্থী হয় তা মানতে অধীনস্থরা বাধ্য নয়।
সীমান্ত প্রহরা দেয়া (বর্তমান সময়ে স্থল, সমুদ্র ও আকাশসীমা) রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহর পথে একদিন সীমান্ত প্রহরা দেয়া দুনিয়া ও এর ওপর যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। (তিরমিজি)
জান্নাতে তোমাদের কারো চিবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া এবং ভূপৃষ্ঠের সব কিছুর চেয়ে উত্তম। আল্লাহর পথে বান্দার একটি সকাল বা বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া এবং ভূপৃষ্ঠের সব কিছুর চেয়ে উত্তম। (তিরমিজি)
রাসূল সা: বলেন, প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির সব কাজের ওপর সীলমোহর করে দেয়া হয় (কাজের পরিসমাপ্তি ঘটে) কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দেয়া অবস্থায় মারা যায় আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত তার কাজের সওয়াব বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং তাকে কবরের সব ফিতনা থেকে নিরাপদ রাখেন। (তিরমিজি)রাসূল সা: বলেন, দু’টি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না; যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং যে চোখ আল্লাহর পথে (নিরাপত্তার জন্য) পাহারা দিয়ে নিদ্রাহীন রাত কাটায়। (তিরমিজি)
ইসলামে ন্যায়যুদ্ধের জন্য পুরস্কার: ইসলামে ন্যায়যুদ্ধের পুরস্কার মূলত পরকালে, দুনিয়ার সম্পদ নয়। মহান আল্লাহ বলেন : ‘নিশ্চয় আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মুমিনের থেকে তাদের জান ও মাল এর বিনিময়ে যে, অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।’ (কুরআন ৯ : ১১১)
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়াই করবে ও নিহত হবে কিংবা বিজয়ী হবে, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট প্রতিফল দান করব।’ (কুরআন ৪ : ৭৪)

রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহর কোনো বান্দা এমতাবস্থায় মারা যায় যে, আল্লাহর কাছে তার সাওয়াব রয়েছে তাকে দুনিয়ার সব কিছু দিলেও দুনিয়ায় ফিরে আসতে আগ্রহী হবে না, একমাত্র শহীদ ব্যতীত। সে শাহাদাতের ফজিলত দেখার কারণে আবার দুনিয়ায় ফিরে এসে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার প্রতি আগ্রহী হবে। (বুখারি)
রাসূল সা: বলেন, সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, আমি পছন্দ করি আমাকে যেন আল্লাহর রাস্তায় শহীদ করা হয়। আবার জীবিত করা হয়, অতঃপর শহীদ করা হয়। আবার জীবিত করা হয়, পুনরায় শহীদ করা হয়। আবার জীবিত করা হয়, আবার শহীদ করা হয়। (বুখারি)। নবী সা: বলেছেন, আমি আজ রাতে (স্বপ্নে) দেখতে পেলাম যে, দু’ব্যক্তি আমার নিকট এলো এবং আমাক নিয়ে একটি গাছে উঠল। অতঃপর আমাকে এমন উৎকৃষ্ট একটি ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিলো এর আগে আমি কখনো এর চেয়ে সুন্দর ঘর দেখিনি। সে দু’ব্যক্তি আমাকে বলল, এই ঘর হচ্ছে শহীদদের ঘর। (বুখারি)
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন : ইসলাম যেমন ন্যায়যুদ্ধে শহীদ হওয়াকে অত্যধিক মর্যাদা দিয়েছে তেমনি যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়নকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছে :‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা যখন একটি সৈন্যবাহিনীরূপে কাফেরদের সম্মুখীন হও, তখন তাদের মোকাবেলা করা থেকে কখনো পশ্চাৎমুখী হবে না। এরূপ অবস্থায় যে লোক পশ্চাৎমুখী হয়-যুদ্ধ কৌশল হিসেবে কিংবা অপর কোনো বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে এটি করা হলে অন্য কথা- সে নিশ্চয়ই আল্লাহর গজবে পরিবেষ্টিত হবে। জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা আর তা প্রত্যাবর্তনের পক্ষে বড়ই খারাপ জায়গা।’ (কুরআন ৪:১৫-১৬)
বিশ্বাসঘাতকতা করা হারাম কাজ: রাসূল সা: বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের নিতম্বের নিকট তার বিশ্বাসঘাতকতার একটি বিশেষ পতাকা উত্তোলন করা হবে। (মুসলিম, হাদিস নং-৪৩৮৭)
রাসূল সা: আরো বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার বিশ্বাসঘাতকতা পরিমাণ পতাকা উত্তোলিত হবে। সাবধান! বিশ্বাসঘাতক জনপ্রতিনিধি বা রাষ্ট্রপ্রধানের চাইতে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কোনোটিতেই নয়। (মুসলিম, হাদিস নং-৪৩৮৮)
একজন সাধারণ সৈনিক আর সেনাপ্রধানের বিশ্বাসঘাতকতার ফলাফল এক নয়। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের মাত্র তিন হাজার সৈন্যের বিপরীতে নবাব সিরাজউদদৌলা বাহিনীর জনবল ছিল ৫০ হাজার। ওই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে আমাদেরকে ১৯০ বছর ব্রিটিশদের গোলামি করতে হয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যে আমাদেরকে তারা দু’টি দুর্ভিক্ষ উপহার দেয় যাতে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেছিল।
ইসলামের যুদ্ধ নীতি : এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে; যেমন- যুদ্ধে বেসামরিক লোক হত্যা করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। ইসলামের ইতিহাসে গণহত্যার কোনো নজির নেই। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় এটম বোমা ফেলে একদিনে এক লাখ ২০ হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়। দুদিন পর নাগাসাকিতে একইভাবে এটম বোমা ফেলে বেসামরিক নাগরিক হত্যা করা হয়।

ফ্রান্স আলজেরিয়ার একটি শহর (Laghouat) দখল করার পর এর ৩ ভাগের ২ ভাগ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে, এক রাতে ওই দেশে ১৭টি নিউক্লিয়ার টেস্ট করে যাতে হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফ্রান্স আলজেরিয়া ত্যাগ করার আগে ১১ মিলিয়ন ল্যান্ড মাইন পুঁতে রাখে যা আলজেরিয়ার জনসংখ্যার চেয়েও বেশি ছিল। এই হচ্ছে ইউরোপীয় সভ্যতার যুদ্ধনীতি। এরাই আবার প্রচার করে যে, ইসলাম নাকি সন্ত্রাসের (Terrorism) ধর্ম। আসলে তারা তাদের অতীত ও বর্তমানের নৃশংস ও অমানবিক যুদ্ধকে আড়াল করার জন্যই ইসলামের ওপর অহেতুক দোষ চাপিয়ে থাকে।
প্রফেসর কেএস রামকৃষ্ণ রাও বলেন : মোহাম্মদ সা: যুদ্ধক্ষেত্রকেও মানবিক করেছেন। তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন কারো তহবিল হস্তগত করা, ধোঁকা দেয়া, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, নির্যাতনপূর্বক হত্যা, অঙ্গচ্ছেদ করা, শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধ হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, লুটতরাজ করা, সম্পদ নষ্ট করা, ফলবান বৃক্ষ কাটা, উপাসনাকারী কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা ইত্যাদি।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যদি এক দলকে অপর দল দ্বারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা করতে না থাকতেন, তাহলে যে খানকা, আশ্রম, গির্জা, উপাসনালয় এবং মসজিদে আল্লাহর নাম বিপুলভাবে জিকির করা হয়- সে সবই চুরমার করে দেয়া হতো।’ (কুরআন ২২:৪০)
এ শিক্ষার আলোকেই যুগে যুগে মুসলিম সেনাবাহিনী ও মুসলিমরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে মানবিক আচরণ করেছে ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী যে, রাসূল সা:-এর মক্কা বিজয় এবং পরবর্তীতে জেরুসালেম ও স্পেন বিজয়ের সময় মুসলিম সেনাবাহিনীর আচরণ কেমন মানবিক ছিল। অথচ ক্রুসেডরদের জেরুসালেম দখলের সময় বা খ্রিষ্টান সেনাবাহিনীর স্পেন দখলের সময় তাদের আচরণ কত বর্বরোচিত ছিল। এখনো যেকোনো মুসলিম দেশে অমুসলিমরা যথেষ্ট নিরাপত্তা ও শান্তিতে বসবাস করে থাকে অথচ বেশির ভাগ অমুসলিম দেশে মুসলিমরা নানারকম বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। ‘অহিংসাই পরম ধর্ম’ এই মতবাদের অনুসারী বৌদ্ধরা মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয়ভাবে, ভিন্ন মতের অনুসারী রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য কী রকম নৃশংসতার পরিচয় দিচ্ছে তা আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com