সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক একটি জাতীয় দৈনিকে গত ৯ আগস্ট বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে। আমরা সবাই শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছি এবং নতুন বিশ্বাসে বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যতের আশা আবার আমাদের পুনর্জাগরিত হয়েছে। এই বিজয়ের জন্য ছাত্র-জনতাকে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। শত শত মানুষ পঙ্গুত্বের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। অনেক পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি আমাদের সহানুভূতি, সমবেদনা অঢেল। আমি নিশ্চিত, সরকারসহ সবাই তাদের দুঃখ লাঘবে যথাসম্ভব চেষ্টা করবে। গত ৫ আগস্ট সরকারকে বিদায় করেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা বিজয় উল্লাস করতে করতে
ঘরে ফিরে যায়নি। তারা রাষ্ট্র মেরামতের নতুন দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে এবং সুচিন্তিতভাবে কাজে নেমে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে, পাড়া-মহল্লায় পাহারা দিচ্ছে। একই সঙ্গে তারা নতুন সরকার গঠনেও ভূমিকা রেখেছে। তবে দেশ এবং বিশেষত নতুন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলোকে বড় দাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কয়েক মাস ধরেই খারাপ ছিল এবং গত এক মাস অর্থনীতি প্রায় স্থবির ছিল। অর্থাৎ, অর্থনীতি হলো দ্বিতীয় বড় সমস্যা। তৃতীয় সমস্যা রাজনৈতিক।
আমাদের পুলিশ পালিয়ে গিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আমাদের মোটেই আস্থা নেই। ক্ষমতালিপ্সু, দুর্নীতিপরায়ণ ও আইনকানুনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উপযুক্ত কাঠামোর মধ্যে ফিরিয়ে আনা, তাদের মধ্যে খারাপ লোকগুলোকে চিহ্নিত করা এবং তাদের প্রতি আমাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান দু-এক মাসে অসম্ভব। তবে এগুলো সংস্কারের জন্য কিছু দৃশম্যান উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। যতদূর জেনেছি, গত ১৫ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে যে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের সম্ভবত একজনকেও নি¤œ আদালত জামিন দেননি। বিচার বিভাগের এই অকল্পনীয় আচরণ আমাকে বিস্মিত করেছে। যদিও ৫ আগস্টের পর নির্বাহী আদেশে গ্রেপ্তারকৃতদের কারামুক্তি শুরু হয়েছে। অনেকে ছাড়াও পেয়েছেন। কিন্তু আদালত থেকে জামিন না দেওয়াটা বিচার বিভাগের জন্য একটা কলঙ্কিত অধ্যায় বলে মনে হয়েছে। তাই এই বিচারহীনতারও সমাধান দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। আমরা প্রায় সবাই ভুলে গেছি, কারাদ- হবে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর। কিন্তু আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কারাভোগ করতে হবে।
উচ্চ আদালতের ব্যাপারেও প্রচুর পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আছে। উচ্চ আদালতে দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল প্রায় সিকি শতাব্দী আগে। উত্তরোত্তর এই প্রবণতা প্রবলতর হয়েছে। এর অর্থ এই নয়, অধিকাংশ বিচারপতি তাদের বিচারিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন না। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার দিকে এখনই নজর দিতে হবে। উচ্চ আদালতে বিচারকদের আদালত বর্জন করা, তাদের ভয়ভীতি দেখানো এবং অন্য কোনোভাবে চাপ সৃষ্টি করা উচ্চ আদালতকে অন্তত ৫০ বছরের জন্য ভীষণ সংকটে ফেলে দেবে। তাই সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং চিন্তাভাবনা করে সমস্যা সমাধানে দীর্ঘস্থায়ী উপায় নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এবং সেই সঙ্গে কিছু ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের ন্যায্য অভিযোগ নিঃসন্দেহ আছে। অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও বেআইনি ও পক্ষপাতিত্বমূলক সুযোগ-সুবিধার কারণে অস্থিরতা বিদ্যমান। এসব সমস্যার সমাধান দু-এক দিনে করা যাবে না। প্রয়োজনে এসব ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিজ্ঞজনের সমন্বয়ে একটা কমিটি বা কমিশন করে সমাধান খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিতে হবে।
রাজনৈতিক সমস্যা এই মুর্হূতে সবচেয়ে প্রকট মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটা বড় রাজনৈতিক দল অর্থাৎ, বিএনপি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার দাবি তুলেছে। আরও অনেক রাজনৈতিক দল স্বাভাবিকভাবেই মনে করতে পারে, যেহেতু এখন মাঠে আওয়ামী লীগ নেই, তাই যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হয়, ততই তাদের জন্য মঙ্গল। অন্যদিকে, আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার চাচ্ছে। তারা চায়, আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। এই বিপরীতমুখী চাপ সামলানো অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান বাস্তবতায় অতিদ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সূচনা অন্তত করতে হবে। এই সংস্কার ছাড়া আবার দ্রুত নির্বাচন হলে আমার আশঙ্কা ভিন্ন মোড়কে আবার একদলীয় শাসন কায়েম হয়ে যেতে পারে। আশা করব, এটা আমার অমূলক আশঙ্কা এবং আমরা সবাই মিলে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি সত্যিকারের সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করে সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাব। অন্যথায়, এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিরাট আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া গণঅভ্যুথানে অনেকে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দোষীদের বিচার প্রক্রিয়ায় আনার ব্যবস্থা এখনই শুরু করতে হবে। আর বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজ রুই-কাতলাদেরও পাকড়াও করতে হবে। বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের অপরাধলব্ধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা নেই এমন লোক দেশে এখন অন্তত খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার অনেক সমস্যার সমাধান করবে এবং বাকি সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দেবে– এটাই প্রত্যাশা।