সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:২১ অপরাহ্ন

হাইকোর্টের রুল: তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল কেন অসাংবিধানিক নয়

শাহ্জাহান সাজু:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৪

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের প দশ সংশোধনীর বৈধতা ও সাংবিধানিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বে এ রুল দেন। প দশ সংশোধনীকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা আট সপ্তাহের মধ্যে ব্যাখ্যা করতে বলেছেন আদালত। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বিদ্যমান ৪৫-এর স্থলে ৫০ করা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি ফয়েজ আহমেদ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আযাদ। সংবিধানের প দশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন।
এরআগে ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল’ শিরোনামে ০৮ অক্টোবর ২০২৩ মনজুরুল ইসলাম-এ নিবন্ধে লিখেছেন,‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে। এরপর ২২ জানুয়ারির পূর্বনির্ধারিত নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। নতুন ভোটার তালিকা ও ছবিযুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল জয় পায়। আওয়ামী লীগ একাই ২৩০টি এবং মহাজোটের শরিক দলগুলো ৩২টি আসন পায়। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট মাত্র ৩৩টি আসনে জয়ী হয়। এর মধ্যে বিএনপি ৩০টি এবং জোটসঙ্গীরা ৩টি আসন পেয়েছিল। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। খালেদা জিয়া হন বিরোধীদলীয় নেতা।মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার বছরখানেক পর ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জিয়াউর রহমানের আমলে করা প ম সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করে। এরপরই সংবিধান সংশোধনের তোড়জাড় শুরু হয়। আপাতদৃষ্টে মনে হয়েছিল, সামরিক শাসনামলে সংবিধানে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল, সেগুলো সংশোধনের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এমন উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও তেমন ইঙ্গিত ছিল। সংবিধান সংশোধনের জন্য ২০১০ সালের ২১ জুলাই ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি করা হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে কমিটির জন্য নাম চাওয়া হলেও তারা এতে সাড়া দেয়নি। তাই ‘সর্বদলীয়’ বলা হলেও কমিটির সব সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের। তৎকালীন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছিলেন কমিটির চেয়ারপারসন, কো চেয়ারপারসন ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ২০১১ সালের ৫ জুন পর্যন্ত কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি ও নানা শ্রেণিপেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মোট ২৭টি বৈঠক করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠক হয়।
এসব বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচ্য বিষয় ছিল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ ব্যক্তিই কিছু সংস্কারসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল কমিটির ২০তম সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল বিশেষ সংসদীয় কমিটির সভায় অংশ নেয়। সভায় প্রধানমন্ত্রী তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখেই সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব দেন। সপ্তাহ দুয়েক পর ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি এক সংক্ষিপ্ত আদেশে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। তবে ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে পরবর্তী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন হতে পারে—এমন কথাও বলেন তাঁরা। আদালতের এই রায়ের পরেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখে বিশেষ কমিটি সর্বসম্মতভাবে একটি সুপারিশ তৈরি করে।
২০১১ সালের ৩০ মে বিশেষ সংসদীয় কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে। পরে ৫ জুন কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ চূড়ান্ত করে এবং ৮ জুন তা স্পিকারের কাছে পাঠায়। সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদের বেশি সংশোধনের প্রস্তাবসংবলিত কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ প দশ সংশোধনী বিল হিসেবে ২৫ জুন তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সংসদে উত্থাপন করেন। সংসদে বাজেট অধিবেশন চলাকালে ৩০ জুন তা পাস হয়। সংশোধনীটি পাসের সময় বিএনপি-জামায়াতের সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া একটি সংক্ষিপ্ত আদেশকে ‘বাধ্যবাধকতা’ হিসেবে দেখিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু যে প্রেক্ষাপট ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ রায় দেওয়া হয়, তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। যে মামলার সূত্র ধরে এ রায় দেওয়া হয়, সেটি ২০০৪ সাল থেকে আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় ছিল।
২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই এ মামলার শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ১ মার্চ শুরু হয়ে মাত্র ১০ কার্যদিবসে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলার শুনানি শেষ হয় এবং বিচারপতি খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার মাত্র আট দিন আগে একটি সংক্ষিপ্ত আদেশ দেওয়া হয়। প্রায় ১৬ মাস পরে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আদেশের কিছু পার্থক্যও দেখা গেছে।
লক্ষণীয় বিষয়, আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির মধ্যে তিনজন এবং ১০ অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে আটজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। ‘দ্য জুডিশিয়ালাইজেশন অব পলিটিকস ইন বাংলাদেশ: প্র্যাগমাটিজম, লেজিটিমেসি অ্যান্ড কনসিকুয়েন্সেস’ প্রবন্ধে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষক রিদওয়ানুল হক বলেছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) করা হয়েছিল। এটি শুধু নীতিগত বিষয় নয়, এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সংকটও জড়িত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ (সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক) যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন, তখন তাঁরা এর রাজনৈতিক পরিণতির বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন কি না—প্রবন্ধে সে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
প দশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে এবং সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে ‘একতরফা’ নির্বাচন হয়। এতে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থীরা ভোটের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পায় এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয় দফা সরকার গঠন করে। একইভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, যাতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়। প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনে মহাজোট ২৮৮ আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে।
দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন নিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ ‘মোর দ্যান মিটস দ্য আই’ বইয়ে লিখেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাকে গুরুতরভাবে আঘাত করেছে। ২০১১ সাল পর্যন্ত ৯টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ৪টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন হয়েছে। এগুলোকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচনা করা হয়। …দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়—এই আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো প্রহসনমূলক বলে বর্ণনা করেছে। প দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক কিছু ফিরিয়ে আনা হয়েছে—আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হয়। কিন্তু এ সংশোধনীতে সামরিক শাসনামলের কিছু বিধান রেখে দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেকে প দশ সংশোধনীকে ‘অসংগতিপূর্ণ’ বলেছেন। যেমন—সংবিধানে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্মের অবস্থান।
প দশ সংশোধনী সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল তাঁর ‘আওয়ামী লীগের শাসনকাল’ বইয়ে লিখেছেন, ‘…খালেদা জিয়া সংবিধান সংশোধন করে পছন্দমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা প দশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তবে তিনি আরও বহু কিছু করেছেন এই সংশোধনীর মাধ্যমে। তিনি জিয়া ও এরশাদের রাজনীতি কিছুটা দখল করেছেন এবং আরও যা ভয়াবহ, তিনি বাকশালকেও কিছুটা ধারণ করেছেন। অভূতপূর্ব প দশ সংশোধনী তাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রতিটি আমলের বিস্বাদ জগাখিচুড়ি।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com