শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৪ পূর্বাহ্ন

সাহাবায়ে কেরামের বীরত্ব

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৪

মহানবী সা: ছিলেন সত্যের ব্যাপারে আপসহীন। হক কথা বলতে, হক প্রচার করতে, হক অনুযায়ী আমল করতে কারো পরোয়া করতেন না। ভয় করতেন না আল্লাহ ছাড়া কাউকে। কাফিররা তাঁকে দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য সম্পদ, নারী, ক্ষমতা ইত্যাদির লোভ দেখিয়েছে; কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি এ দাওয়াত থেকে বিরত থাকব না। তিনি আল্লাহর শেখানো বাণীই বলতেন- ‘বলুন! এই আমার পথ, আমি মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিই।’ (সূরা ইউসুফ-১০৮) তিনি দাওয়াত ও দ্বীন প্রচারের জন্য এমন একটি দল গঠন করেছিলেন যারা তাঁর আদর্শে আদর্শবান এবং তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। তাঁরা সত্য পালনে বজ্রকঠোর এবং সিদ্ধান্তে ইস্পাত কঠিন অটল। যাদের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা- ‘মুহাম্মাদ সা: এবং তাঁর সাথীরা কাফিরদের ক্ষেত্রে বজ্রকঠোর এবং নিজেদের বেলায় রহমতস্বরূপ।’ (সূরা আল ফাতহ-২৯)
সাহাবায়ে কেরামের বীরত্ব : সাহাবায়ে কেরাম সবাই ছিলেন বীর। তাদের বীরত্ব প্রকাশ পেয়েছে কেবল দ্বীনের স্বার্থে, ব্যক্তি স্বার্থে নয়। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েক জন হলেন-
হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:- হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: মুসলমান হওয়ার পর থেকে সব জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। তাবুক যুদ্ধে তিনি মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন। খিলাফতের দায়িত্ব প্রহণ করার পর একদল মুসলমান জাকাত দিতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। হজরত ওমর রা: বললেন- আপনি তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করবেন যারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: বলেন, যারা নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব। পরে হজরত ওমর রা: নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন।
হজরত ওমর ফারুক রা:- মহানবী সা: দোয়া করেছিলেন- হে একদল! ওমর ইবনে খাত্তাব এবং আবু জেহেলের মধ্যে আপনার কাছে যে অধিক পছন্দনীয় তাকে মুসলমান করে ইসলামকে শক্তিশালী করুন। একদল তায়ালা ওমর ইবনে খাত্তাবকে কবুল করেন। তিনি মুসলমান হওয়ার পর কুরাইশদের কাছে তা ব্যক্ত করলে তারা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনিও তাদেরকে প্রহার করেন এবং বলেন, আল্লাহর শপথ! যদি আমরা সংখ্যায় তিন শ’ জনও হতাম, তাহলে মক্কায় হয় তোমরা থাকতে অথবা আমরা থাকতাম (ইবনে হিশাম, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৩৪৮) তার তিন দিন আগে মুসলমান হন হামজা রা:। উভয়ই ছিলেন বীর। হজরত ওমর ফারুক রা: রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে গিয়ে আরজ করলেন, হে রাসূল সা:! আপনি কি সত্য নবী নন? রাসূল সা: বলেন, ‘অবশ্যই সত্য নবী’। ইসলাম কি সত্য দ্বীন নয়? রাসূল সা: বলেন, ‘অবশ্যই সত্য দ্বীন’ তা হলে গোপনীয়তা কেন? আমরা প্রকাশ্যে তাওয়াফ করব, প্রকাশ্যে নামাজ পড়ব। অতঃপর মুসলমানরা দু’কাতারে বিভক্ত হলেন, এক কাতারের সামনে হজরত ওমর রা:, অপর কাতারের সামনে হজরত হামজা রা:, আর মাঝখানে মহানবী সা: দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে তাওয়াফ করেন। প্রকাশ্যে আজান ও দ্বীনের প্রচার হজরত ওমর রা: শুরু করলে মহানবী সা: তাকে ফারুক উপাধি দান করেন।
হজরত আলী রা:- তার উপাধি হলো- হায়দার বা সিংহ, আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারি, শের-ই জায়দান বা আল্লাহর সিংহ ইত্যাদি। তিনি বদর, উহুদ, খন্দক ইত্যাদি বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি ১৬টি আঘাতপ্রাপ্ত হন। উহুদের মাঠে এমন বীরত্ব দেখিয়েছিলেন যে, হজরত জিবরাইল আ:-তার বীরত্বের প্রশংসা করেছেন। হজরত আলী রা: কোনো কাফিরকে মহানবী সা:-এর কাছে আসতে দেননি। রাসূল সা: তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন- ‘অবশ্যই আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে।’ হজরত জিবরাইল আ: এ কথা শুনে বলেন, আর আমি আপনাদের উভয় থেকে। (কুররাতুল আইন)
হজরত হামজা- স্নেহের ভাতিজাকে আবু জেহেল গালি দেয়ায় তিনি ধৈর্যহারা হন। পরে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের জন্য তাকে কবুল করেন। তার ইসলাম গ্রহণ ইসলামকে বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। সাহসিকতার জন্য তিনি আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ উপাধি লাভ করেন। তিনি বদরের যুদ্ধে উতবাকে হত্যা করেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়ে সাইয়েদুশ শোহাদা বা শহীদের সর্দার উপাধি লাভ করেন।
হজরত খালিদ ইবনে অলিদ- মুতার যুদ্ধে জায়েদ রা:, হজরত জাফর ইবনে আবু তালেব রা: এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা:-এর শাহাদাতের পর হজরত খালিদ ইবনে অলিদ রা: সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই যুদ্ধে তার হাতে ৯টি তরবারি ভেঙে ছিল। (বুখারি দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৬১১) তার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য দুই লাখ কাফিরের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি জীবনে কোনো যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেননি। তিনি সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারি হিসেবে সুপরিচিত।
হজরত আবদুল্লাহ ইবন জাহস ও হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা:- তারা উভয়ে উহুদের যুদ্ধের প্রাক্কালে একত্রে দোয়া করেছিলেন। হজরত সাদ রা: দোয়া করেন, হে আল্লাহ! আগামীকাল যুদ্ধে আমি যেন শত্রুকে পরাজিত হত্যা করে তার ধনসম্পদ লাভ করতে পারি। হজরত আবদুল্লাহ বলেন, আমিন। হজরত আবদুল্লাহ ইবন জাহস দোয়া করেন, হে আল্লাহ! আগামীকাল যুদ্ধে আমি যেন শহীদ হই এবং তারা যেন আমার নাক, কান কেটে নেয়। বিচার দিবসে আমি যেন আল্লাহর দরবারে এ অবস্থায় হাজির হতে পারি। হজরত সাদ রা: বলেন, আমিন। আল্লাহ তায়ালা উভয়ের দোয়া কবুল করেন। (ইসাবা, সাহাবা চরিত)
হজরত হানজালা রা:- তিনি নতুন বিয়ে করেছেন। নববধূর সাথে রাত যাপন করেন। হঠাৎ উহুদ যুদ্ধের ঘোষণা শুনতে পান। রাসূলপ্রেম ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা তার এত তীব্র ছিল যে, ফরজ গোসলের কথা ভুলে যান। নাপাক শরীরে যুদ্ধ করতে থাকেন। একপর্যায়ে শাদ্দাদ ইবনে আওসের তরবারির আঘাতে শাহাদাতবরণ করেন। এ বীর যোদ্ধাকে ফেরেশতারা জমজমের পানি দিয়ে গোসল করান।
হজরত আমর ইবনে জুমুহ- তিনি ছিলেন খোঁড়া। ঠিকভাবে হাঁটতে পারতেন না। তাই রাসূল সা: তাকে উহুদ যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেননি; কিন্তু তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা, যুদ্ধে যাবেনই। পরে মহানবী সা: যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। অতঃপর তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার সময় বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি জান্নাত লাভের আশা করি। অতঃপর উহুদের যুদ্ধে তিনি ও তার এক পুত্র শাহাদাতবরণ করেন। তার স্ত্রী স্বীয় স্বামী ও পুত্রের লাশ উটের পিঠে করে মদিনায় আনতে চাইলেন; কিন্তু উটটি হঠাৎ বসে পড়ে। বহু প্রচেষ্টার পরও একে উঠানো সম্ভব হয়নি। পরে উহুদের মাঠেই তাদেরকে সমাহিত করা হয়। (সাহাবা চরিত)
হজরত মুসআব ইবনে উমাইর রা:- তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। তিনি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই সুন্দর ও সুঠাম দেহের অধিকারী। সদা মূল্যবান পোশাক পরতেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করার পর তার জীবন কাটে জীর্ণশীর্ণ ও তালি দেয়া জামা কাপড়ে। উহুদ যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা ছিল তার হাতে। যুদ্ধে তিনি আবদুল্লাহ ইবন কোম্মার আঘাতে শাহাদাতবরণ করেন। অতঃপর হজরত আলী রা: পতাকা ধারণ করেন। উহুদ যুদ্ধে তিনি অসাধরণ বীরত্ব সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি ইবনে কোম্মা ও অন্যদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে মহানবী সা:-কে হিফাজত করেন। তাকে কাফন পরানোর জন্য যে কাপড় ছিল তা যথেষ্ট ছিল না। কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে পা ইজখির ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়।
হজরত তালহা রা:- হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: উহুদের যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেছেন, সেদিনের যুদ্ধের একক কৃতিত্ব ছিল তালহার। মহানবী সা:-কে রক্ষা করার দায়িত্ব তিনি সর্বাধিক পালন করেন। উহুদ যুদ্ধে তার দেহে ৩৯টি আঘাত লেগেছিল। তাঁর শাহাদাত আঙুলসহ দু’টি আঙুল নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। (ফতহুল বারি, সপ্তম খ-, পৃষ্ঠা-৩৬১)
হজরত ওহাব ইবনে কাবুস রা:- তিনি ছিলেন একজন গ্রাম্য সাহাবি। তার কাজ ছিল ছাগল চরানো। একদিন ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ছাগল নিয়ে মদিনা আসেন। সেখানে তিনি জানতে পান যে, রাসূল সা: উহুদে গমন করেছেন। অতঃপর তিনি রাসূল সা:-এর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা করেন। ঠিক এ সময় একজন কাফির রাসূল সা:-কে আক্রমণ করতে অগ্রসর হলে রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি এদের তাড়িয়ে দিতে পারবে সে আমার সাথে জান্নাতে যেতে পারবে। অতঃপর হজরত ওয়াহাব রা: তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কাফিরদের প্রতিহত করে তিনিও শহীদ হন। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com