মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা পয়গম্বরদের মধ্যে হজরত দাউদ আ: ও সুলাইমান আ:-কে নবুয়ত ও রিসালাতের সাথে রাজত্ব দান করেছিলেন। রাজত্বও এমন নজিরবিহীন যে, শুধু মানুষের ওপর নয়- জ্বিন ও জন্তু-জানোয়ারদের ওপরও তাঁরা শাসন পরিচালনা করতেন। এমনকি আল্লাহ তায়ালা বায়ুকে সুলাইমান আ:-এর নির্দেশাধীন করে দেন।
কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘সুলাইমান পক্ষীদের খোঁজখবর নিলেন, অতঃপর বললেন, ‘কী হলো, হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেবো কিংবা হত্যা করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ।’ (সূরা নামল : ২০-২১)
আলোচ্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, হজরত সুলাইমান আ: সর্বস্তরের প্রজাদের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতেন। এমনকি, যে হুদহুদ পক্ষীকুলের মধ্যে ক্ষুদ্র ও দুর্বল এবং যার সংখ্যাও দুনিয়াতে অন্যান্য পাখির তুলনায় কম, সেই হুদহুদও তাঁর দৃষ্টির অগোচরে থাকেনি; বরং বিশেষভাবে হুদহুদ সম্পর্কে তাঁর প্রশ্ন করার এক কারণ এটাও হতে পারে যে, হুদহুদ পক্ষীকুলের মধ্যে কমসংখ্যক ও দুর্বল। তাই প্রজাদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখার ব্যাপারে তিনি অধিক যতœবান হয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হজরত ওমর ফারুক রা: তাঁর খেলাফতের আমলে পয়গম্বরদের এই সুন্নাতকে পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করেন। রাতের অন্ধকারে তিনি মদিনার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াতেন, যাতে সবার অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন বা বুঝতে পারেন। কাউকে কোনো বিপদ ও কষ্টে পতিত দেখলে তিনি তাকে সাহায্য করতেন। এ ধরনের অজস্র ঘটনা তাঁর জীবনীতে উল্লিখিত আছে। তিনি বলতেন, যদি ফোরাত নদীর কিনারায় কোনো বাঘ কোনো ছাগলছানাকে গিলে ফেলে, তবে এর জন্যও হাশরের মাঠে আল্লাহর আদালতে আমি ওমরকে প্রশ্ন করা হবে।
এ হচ্ছে রাজ্যশাসন ও প্রজাপালনের রীতিনীতি, যা পয়গম্বররা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, সাহাবায়ে কেরাম রা: যা বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন এবং যার ফলে মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সব শ্রেণীর জনসাধারণ সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করত। তাঁদের পর পৃথিবীতে এমন সুবিচার, ইনসাফ ও সাধারণ বিশ্বের শান্তি, সুখ ও নিশ্চয়তার সে দৃশ্য আর কেউ দেখেননি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরআনের বার্তা : আমানত তথা অন্যের প্রাপ্য যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়া, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, সর্বোপরি কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা একজন দায়িত্বশীলের প্রধান কর্তব্য। দায়িত্বশীলদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার বিষয়ে পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তোমরা আমানত হকদারের কাছে অর্পণ করো।’
তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে, আল্লাহ তোমাদের কতই না উত্তম উপদেশ দেন, আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী, তোমাদের কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে তা আল্লাহ ও রাসূলের কাছে উপস্থাপন করো, এটাই উত্তম ও পরিণামে সুন্দরতর।’ (সূরা নিসা : ৫৮-৫৯)
শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব : শরিয়তের দৃষ্টিতে একজন নেতা নির্বাচন আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মৃত্যুর পর সাহাবারা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:-এর কাছে দায়িত্ব অর্পণ করে শপথ গ্রহণের জন্য এসেছিলেন। এর পর থেকে সব যুগে মানুষের বিভিন্ন বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য কাউকে নিযুক্ত করার নিয়ম চলে আসছে। কখনো মানুষকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হবে না। (মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা-২৯১)
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্ব তুলে ধরে ইবনে তাইমিয়া রহ: বলেছেন, ‘এ কথা জানা জরুরি যে, সমাজে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিধানগুলোর অন্যতম। বরং এটি ছাড়া দ্বীনের অস্তিত্ব থাকে না। কারণ পারস্পরিক প্রয়োজন পূরণে আদমসন্তানের ঐক্য ছাড়া সমাজের কল্যাণ সম্ভব নয়।
এ জন্য রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তিনজন ভ্রমণে বের হলে তারা যেন একজনকে প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে।’ (আস-সিয়াসা আশ-শরইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২০)
কুরআনে বর্ণিত দু’জন মুমিন শাসক : পবিত্র কুরআনে দু’জন শাসকের কথা বর্ণিত হয়েছে। বিশিষ্ট তাবেয়ি মুজাহিদ রহ: থেকে ইবনে কাসির রহ: বর্ণনা করেছেন, চার ব্যক্তি পৃথিবী শাসন করেছেন। এর মধ্যে দু’জন মুমিন ও দু’জন কাফির। মুমিন দু’জন হলেন, হজরত সুলাইমান আ: ও জুলকারনাইন। কাফির দু’জন হলো, নমরুদ ও বখতে নসর। (তাফসিরে ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা-৩১৪, প্রথম খ-)
মহান আল্লাহ তাদের উদ্দেশে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। সুলাইমান আ:-এর রাজত্ব সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুলাইমান আ: ছিল দাউদ আ:-এর উত্তরাধিকারী, সে বলেছিল, হে মানুষ, আমাকে পাখিদের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সবকিছু দেয়া হয়েছে, তা অবশ্যই সুস্পষ্ট অনুগ্রহ। সুলাইমানের সামনে তার বাহিনী জিন, মানুষ ও পাখিদের সমবেত করা হয়, তাদের বিভিন্ন ব্যূহে বিন্যস্ত করা হয়।’ (সূরা নামল-১৯)
অন্য শাসক জুলকারনাইন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আপনাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, আমি তোমাদের কাছে তার বর্ণনা দিচ্ছি। আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং সব বিষয়ে উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম।’ (সূরা কাহাফ-৮৫)
দায়িত্ব অর্পণের রূপরেখা : ইসলামী শরিয়তে যেকোনো দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। জনসাধারণের যেকোনো কাজে দায়িত্বশীল নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যদের প্রাধান্য দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে আমানতদারির নির্দেশনা এসেছে। যেমন পবিত্র কুরআনে মূসা আ:-এর বিশ্বস্ততা প্রসঙ্গে তাঁর স্ত্রীর কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্যত্র শাসনকার্যে ইউসুফ আ:-এর নিয়োগ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘রাজা বলল, ইউসুফকে আমাদের কাছে নিয়ে আসো, তাকে আমি একান্ত সহচর নিযুক্ত করব, অতঃপর তাঁর সঙ্গে কথা বলে রাজা বলল, আজ আপনি আমাদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান ও বিশ্বস্ত।’ (সূরা ইউসুফ-৫৪)
দায়িত্বশীলদের কল্যাণ কামনা : আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর নির্দেশনা পালনকারী দায়িত্বশীলদের অনুসরণ করা সাধারণ মুসলিমদের কর্তব্য। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের তিনটি বিষয় পছন্দ করেন এবং তিনটি বিষয় অপছন্দ করেন। তিনি পছন্দ করেন তোমরা একমাত্র তাঁর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করবে না এবং আল্লাহর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে, বিভেদ করবে না এবং আল্লাহ যাদেরকে তোমাদের দায়িত্বশীল করবেন, তাদের জন্য কল্যাণ কামনা করবে। তিনি অপছন্দ করেন তোমাদের অনর্থক কথাবার্তা, সম্পদের অপব্যয় ও মানুষের কাছে বেশি বেশি চাওয়া। (মুসলিম-১৭১৫)
হাদিস শরিফে হজরত উত্তম শাসকদের মর্যাদার কথা এসেছে। হজরত উমর বিন খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমি তোমাদের উত্তম ও নিকৃষ্ট শাসকদের সম্পর্কে জানাব না? উত্তম শাসক হলো যাদের তোমরা ভালোবাসো এবং তারাও তোমাদের ভালোবাসে। তোমরা তাদের জন্য দোয়া করো এবং তারাও তোমাদের জন্য দোয়া করে। নিকৃষ্ট শাসক হলো যাদের তোমরা ঘৃণা করো এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। তোমরা তাদের অভিশাপ দাও এবং তারাও তোমাদের অভিশাপ দেয়।’ (তিরমিজি-২২৬৪)
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ (কিয়ামতের দিন) সাত শ্রেণীর মানুষকে (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। সেদিন তার ছায়া ছাড়া কোনো ছায়াই থাকবে না-
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক। ২. আল্লাহর ইবাদতে বেড়ে ওঠা যুবক। ৩. মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর যার অন্তর মসজিদে সম্পৃক্ত থাকে, যতক্ষণ না সে তাতে ফিরে আসে। ৪. যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে; তাঁর সন্তুষ্টির জন্য একত্র হয় এবং তাঁর জন্য বিচ্ছিন্ন হয়। ৫. যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। ৬. মর্যাদাবান সুন্দরী নারী ডাকার পর যে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। ৭. যে এমনভাবে দান করে, তার ডান হাত জানে না।’ (বুখারি-৬৮০৬)
দুনিয়ার বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্য হজরত উমরের মতো একজন শাসকের বিকল্প নেই। দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজের স্নেহের পুত্রকে পর্যন্ত ছাড় দেননি খলিফাতুল মুসলিমিন উমর। কোনো ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি স্পর্শ করতে পারেনি তাকে এবং তাঁর কোনো প্রতিনিধিকে। হজরত ওমর নিজে খাদ্যসামগ্রীর বস্তা কাঁধে চাপিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতেন। গভীর রাতে মানুষের খোঁজ নিতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে কঠোর নির্দেশ দিতেন যেন ন্যায়বিচার ও সাহায্য পেতে সাধারণ জনগণ হয়রানির শিকার না হয়। অন্য ধর্মের অনুসারীরা যেন কোনোভাবেই ন্যায়বিচার থেকে বি ত না হয় সে বিষয়ে ছিল আরো কঠোর নির্দেশ। ফলে সবখানে বিরাজ করছিল শান্তির বাতাস। মানুষের মধ্যে ছিল ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে প্রশান্তিময় পরিবেশ। রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়পরায়ণ শাসকের বিকল্প নেই। লেখক : ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।