আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপট
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় দীর্ঘ ১১ বছর স্কুলে কোনো ক্লাস না করিয়ে স্কুল থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন ভাতা এবং একইসঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান পদের মাসিক সম্মানি ভাতা নিয়মিত তুলে নেয়ার অভিযোগ ওঠেছে এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। ঐ আওয়ামী লীগ নেতার নাম আব্দুল্লাহ আল হেলাল। তিনি শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪ নং সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদের দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান এবং হাজী আব্দুল গফুর স্কুল অ্যন্ড কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষক। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়ন এলাকায় অবস্থিত হাজী আব্দুল গফুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৯৯৫ সালের ২০ এপ্রিল সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুল্লাহ আল হেলাল।
তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষক পদে থেকে ২০১১ সালে সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন।
প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ২০১১ সালের ১০ আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। টানা দুুইবার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করায় তিনি দীর্ঘ ১১ বছর ইউনিয়ন পরিষদের নানা কার্যক্রমে অংশ নেয়ায় আব্দুল্লাহ আল হেলাল স্কুলের কোনো ক্লাস করাতে পারেননি। তবে বছরের পর বছর স্কুলের মাসিক বেতনের (এমপিও) সরকারি অংশ তুলেছেন ঠিকই। একই সাথে ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও জনপ্রতিনিধির মাসিক সম্মানি ভাতাও তুলেছেন তিনি। প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী বলেন, হেলাল স্যার চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় কোনোদিন স্কুলের ক্লাস করাননি। তবে মাঝেমধ্যে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো নীতিমালা অনুযায়ী একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক একসাথে দুইটি চাকরি বা আর্থিক লাভজনক অন্য কোনো পদে থাকতে পারেন না। শিক্ষক হেলাল ক্ষমতার অপব্যবহার করে একসঙ্গে দুটি পদে থেকে উভয় প্রতিষ্ঠান থেকেই আর্থিক সুবিধা নেয়ার বিষয়টি ‘অপেন সিক্রেট’ হলেও তৎকালীন সময় এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করেননি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন ও অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই নতুন করে এমপিওভুক্ত ওই শিক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আনেন।
স্থানীয়রা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ইউনিয়ন থেকে সরকার প্রদত্ত মাসিক সম্মানি ভাতা নিয়মিত নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সচিব ও বর্তমান শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৬ নং আশিদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের সচিব দীপক কুমার শর্মা। তিনি বলেন, আমি সিন্দুরখান ইউনিয়নের সচিব থাকাবস্থায় সাবেক চেয়ারম্যান হেলাল প্রত্যেক মাসেই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সম্মানি ভাতার সরকারি অংশ ও ইউনিয়ন পরিষদ তহবিল থেকে প্রাপ্ত অংশ নিয়েছেন। সব ডকুমেন্ট ইউনিয়ন অফিসে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সরজমিনে গতকাল দুপুরে সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় গিয়ে সম্মানি ভাতার তথ্য জানতে চাইলে, সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষের সচিব হিমাদ্রী দেব বলেন, সাবেক দুইবারের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হেলাল ২০১১ সালের ১০ আগস্ট থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নিয়মিত চেয়ারম্যানের সম্মানি ভাতার সরকারি অংশ এবং পরিষদ থেকে প্রদত্ত ভাতা তুলেছেন। রেজিস্ট্রার খাতা/ভাউচার দেখে তিনি সরকার প্রদত্ত ও ইউনিয়ন পরিষদ তহবিল থেকে সম্মানি ভাতা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। হাজী আব্দুল গফুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক তমাল কান্তি ভট্টাচার্য জানান, আমাদের স্কুলের এমপিওভুক্ত শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল হেলাল টানা দুইবার চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় স্কুল থেকে নিয়মিত বেতনের সরকারি অংশ তুলেছেন। ক্লাস না করিয়ে এতো বছর বেতন নেয়ার বিধি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে তিনি ক্লাস না করলেও ওইসময় প্রায়ই স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। তার ক্লাসগুলো করানোর জন্য তার বদলে একজন খন্ডখালীন শিক্ষকও তিনি নিয়োগ দেন। বেতন কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগ থেকেই তিনি ওই স্কুলে যোগদান করেন। তখন বেতনের স্কেল কম ছিল। বর্তমানে প্রতি মাসে বেতনের সরকারি অংশ (এমপিও) ২৪ হাজার ৭০০ টাকা নিচ্ছেন। আর স্কুলের কমিটি থেকে তার বেতন বাবদ আরও কিছু অংশ দেওয়া হয়। ক্লাস না করিয়ে বেতন এবং একসঙ্গে দুই জায়গা থেকে বেতন ও সম্মানির বিষয়ে বিধিমালা কি বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি অবশ্যই নিয়মবহির্ভুত।
অভিযুক্ত শিক্ষকের একসঙ্গে দুই জায়গা থেকে বেতন ও সম্মানি নিতে পারবেন মর্মে একটি পরিপত্র আছে। অভিযুক্ত সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল হেলাল স্কুল থেকে বেতন (এমপিও) ও ইউনিয়ন থেকে সরকার প্রদত্ত সম্মানি ভাতা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমরা কয়েকজন ২০১১ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলাম। হাইকোর্টের রায়ের বলা হয়েছে, বেসরকারি স্কুলের এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ সরকারি কর্মকর্তা নয়। বিধায় তারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাপ্ত সম্মানি ভাতা গ্রহণে আইনগত বাধা নেই। আমার কাছে হাইকোর্টের রায়ের কপি আছে।
কপিটি প্রতিবেদকে দেখানো যাবে কি না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এখন তো আমি নিয়মিত ক্লাস করাই। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমি স্কুলে ক্লাস না করালেও আমার ক্লাস করানোর জন্য অন্য একজন শিক্ষক দিয়েছি। হাইকোর্টের রিটের পর যেহেতু আমাদের পক্ষে কোর্টের রায়ের পরিপত্র আছে নিউজ করে আমাকে বিব্রত না করলে ভালো। রায়ের কপি দেয়ার কথা বললে তিনি বৃহস্পতিবার দিবেন বলেও দেননি। পরে গত রবিবার ছয় পৃষ্ঠার একটি কাগজ দেন। কোর্টের এই কাগজটি মৌলভীবাজার ও ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট নিয়ামুল হকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি কাগজ পড়ে জানান, মহামান্য হাইকোটের এই কাগজে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের চাকরি বা বেতন বিষয়ে কোনো শব্দই লেখা নেই। এটা একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক পদে থেকে নির্বাচন করতে পারবে কি না, বা না পারলে কেনো পারবে না এবিষয়ে রিট করা হয়েছে। এখানে লেখা রয়েছে, বিগত ২০১১ সালের ৩৪৯৭ নং রিট পিটিশন এর রোলিং ছিল, বিবাদীদের কারণ দর্শাতে বলা হয় এবং বিবাদীদের নির্দেশনা দেওয়া বাদিকে ইউপি নির্বাচন করার জন্য অনুমতি প্রদানের। স্কুলের বেতন বা ইউনিয়ন পরিষদের সম্মানি ভাতা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা নেই। আর যদি তিনি জেনেবুঝে কিভাবে মিথ্যায় আশ্রয় নিয়ে কোর্টের রিট পিটিশনকে কোর্টের রায় বলে প্রচার করছেন, এটাও তো অন্যায়, মিথ্যাচার। শ্রীমঙ্গল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দীলিপ কুমার বর্ধন বলেন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হেলাল চেয়ারম্যান থাকাকালীন এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে হাজী আব্দুল গফুর স্কুলে চাকরি করতেন তা জানি। কিন্তু আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন কিনা তা আমি জানি না। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের সময় তিনি ১১ বছর স্কুলে অনিয়মিত থেকে মাসিক বেতনের সরকারি অংশ ঠিকই নিয়মিত তুলেছেন এটা কী অনিয়ম নয় প্রশ্ন করলে শিক্ষা অফিসার বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান আমাকে বলেছিলেন ইউপি চেয়ারম্যানরা শিক্ষক পদে থাকলে বেতন নিতে পারবেন, এটা নাকি তারা হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে রায় পেয়েছে। আপনি ওই স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন তারা কিভাবে মাসে মাসে বেতনভাতা তোলার সুযোগ দিয়েছেন। মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার ফজলুর রহমান বলেন, আব্দুল্লাহ আল হেলাল এর বিষয়টি আমার জানা নেই। তিনি চেয়ারম্যান পদে থাকাবস্থায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির কেউ আমাকে অবগত করেনি। তার এ বিষয়টি নীতিমালা কী বলে প্রশ্ন করলে শিক্ষা অফিসার বলেন, একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক একইসঙ্গে দুইটি আর্থিক লাভজনক পদে থাকা নীতিমালা বহির্ভূত। আর ১১ বছর ক্লাস না করিয়ে তিনি বেতন নিয়ে থাকলে সেটা নীতিমালা বর্হিভুত। বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখবো। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সদ্যগঠিত স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আবু তালেব বলেন, ঘটনাটি কেউ জানায়নি, এখন আপনার কাছ থেকে জানলাম। একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক একইসঙ্গে দুইটি আর্থিক লাভজনক পদে থেকে দুইটি সুবিধা ভোগ করার বিধান নেই। আপনি ওই শিক্ষের নাম ও স্কুলের নামসহ কোনো ডকুমেন্ট থাকলে আমার হোয়াটসঅ্যাপে দেন, বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অফিস সিলেট এর আ লিক উপপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু সাঈদ মো: আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, আমি মৌলভীবাজার থাকাকালীন এ ধরনের কয়েকজনকে পেয়েছিলাম। এটা নিয়মবহির্ভূত এবং নৈতিকতা অনুযায়ী কোনোভাবেই এটা বৈধ না। আপনি একটু চিন্তা করেন ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এক ব্যক্তি কি করে শিক্ষকতা করেন বা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন? এক ব্যক্তি স্কুলে ক্লাস করাবেন কখন আর ইউনিয়ন চালাবেন কখন? একই টাইমে দুইটা আর্থিক লাভজনক প্রতিষ্ঠানে থেকে সরকারি সুবিধা ভোগ করা কোনো আইনে নেই। আর ক্লাস না করিয়ে সরকারি এমপিও নিবেন কোন বিধির আলোকে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল অ্যান্ড কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষক একইসাথে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে দুইটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে স্কুলের বেতন ও ইউপি থেকে সম্মানি নিতে পারেন কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত-সচিব (মাধ্যমিক অনুবিভাগ-২) মো: রবিউল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের সব জায়গায় একই নিয়ম যে, এক ব্যক্তি দুই জায়গা থেকে বেতন গ্রহণ করতে পারবেন না। যদি কেউ একসঙ্গে দুই জায়গা থেকে সরকারি বেতন বা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন প্রমাণিত হয় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।