সৃষ্টিকুলে যে মহামনীষীগণ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারা শিষ্টাচার ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। মহানবী সা: ছিলেন শিষ্টাচারের মূর্তপ্রতীক। উত্তম ব্যবহারের জন্য তিনি ছোট-বড় সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং আস্থার পাত্র ছিলেন। সংযম, বিনয়, ভদ্রতা ছিল তাঁর ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সা: আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগে কাফেরদের হৃদয় জয় করেছেন এবং আল-আমিন নামেও ভূষিত হয়েছেন। নবী সা:-এর পরবর্তী যুগেও সাহাবিরা এই শিষ্টাচারের মাধ্যমেই গোটা পৃথিবী জয় করেছেন। সুতরাং বলা যায়, মানবজীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্র গঠনে যেকোনো সমস্যা নিরসনে এই শিষ্টাচার খুবই জরুরি বিষয়।
শিষ্টাচারের গুরুত্ব : আদর্শ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। শিষ্টাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুওয়াতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ।’ (আবু দাউদ-৪৭৭৬)
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা: বলেন : ‘তুমি আদব অন্বেষণ কর। কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের অকাট্য দলিল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রবাসজীবনের সঙ্গী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ’। (ইসবাহানি মুনতাখাব; সাফারিঈনি, গিযাউল আলবাব, ১/৩৬-৩৭)
শিষ্টাচার হলো ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ, যা মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। এই গুণ হঠাৎ করেই কারো মধ্যে গড়ে ওঠে না। এর জন্য গ্রহণ করতে হয় দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপিত হয় শিশুকালে। এক্ষেত্রে পারিবারিক ভূমিকাই প্রধান। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। পরিবারের বড়রা যেরকম ব্যবহার করে শিশুরাও তাই অনুসরণ করে।
কুরআনের আলোকে শিষ্টাচার : শিষ্টাচারের বিভিন্ন দিক কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘তুমি ক্ষমার নীতি গ্রহণ করো। লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলো।’ (সূরা আ‘রাফ : ১৯৯) এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন : ‘ভালো ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না। তুমি উত্তম দ্বারা (অনুত্তমকে) প্রতিহত করো। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারে, যারা ধৈর্যধারণ করে এবং এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারে, যারা মহা ভাগ্যবান।’ (হা-মিম সাজদাহ্ : ৩৪-৩৫)
হাদিসের আলোকে শিষ্টাচার : ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। যা মানুষকে সর্বোত্তম আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার জন্য এসেছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি’। (মিশকাত : ৫০৯৬)
হজরত আনাস ইবনু মালিক রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : নবী সা: গালি-গালাজকারী, অশালীন ও লা’নতকারী ছিলেন না। তিনি আমাদের কারো ওপর অসন্তুষ্ট হলে, শুধু এতটুকু বলতেন, তার কী হলো? তার কপাল ধূলিমলিন হোক! (বোখারি : ৬০৩১) তিনি আরো বলেন : আমি দশটি বছর নবী সা:-এর খিদমত করেছি। কিন্তু তিনি কখনো আমার প্রতি উহ: শব্দটি করেননি। এ কথা জিজ্ঞেস করেননি, তুমি এ কাজ কেন করলে এবং কেন করলে না? (বোখারি : ৬০৩৮)
দৈনন্দিন জীবনে শিষ্টাচার : জীবনের প্রতিটি কাজ একটি নীতি-আদর্শ অনুসারে বা শিষ্টাচার অনুযায়ী চলতে হয়। শৃঙ্খলা অনুসারে চললে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে। নির্দেশনা অনুসারে কাজ করা না হলে সে কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় না এবং তাতে কাক্সিক্ষত ফলও অর্জিত হয় না। মানুষের সাথে ওঠাবসা, পানাহার, বসবাস ও সহাবস্থান সমাজজীবনের মৌলিক কাজ। এসব প্রাত্যহিক কর্মকা-ে শিষ্টাচারের সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন মহানবী সা:। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন : ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা আল-ক্বলম : ৪)
সালাম বা সম্ভাষণ : ইসলামী জীবনবিধানে ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সালামের জবাব দেয়ার জন্যও অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যখন তোমরা সালাম ও অভিবাদনপ্রাপ্ত হও, তখন তোমরা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর সম্ভাষণ করো অথবা একইভাবে অভিবাদন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।’ (সূরা নিসা : ৮৬)
প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা : প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা মুসলমানের অন্যতম কর্তব্য। সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : তোমরা সদাচরণ কর নিকটাত্মীয়, অনাথ, নিঃস্ব, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, পার্শ্বস্থিত সঙ্গী, পথিক ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসেন না যারা গর্বে স্ফীত অহঙ্কারী। (সূরা আন-নিসা : ৩৬) প্রতিবেশীর হক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তাকে কষ্ট দেয়া হারাম। আবু শুরাইহ রা: থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল্ল্লুাহ সা: বলেন : আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, কে সে জন ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন, যার প্রতিবেশী তার অত্যাচার থেকে নিরাপদে থাকতে পারে না। (মিশকাত : ৪৯৬২)
লজ্জাশীলতা : লাজুকতা সভ্যতা বিকাশে রুচির পরিচায়ক। নবী সা: ছিলেন লজ্জাশীলতার মূর্তপ্রতীক। হজরত সালিম ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা: দেখলেন, এক ব্যক্তি তার ভাইকে লাজুক স্বভাবের জন্য তিরস্কার করছে। তিনি তাকে লক্ষ করে বললেন : তাকে ছেড়ে দাও। মনে রেখো লজ্জা ঈমানের অংশ। (সহিহ, মুসলিম) এ মর্মে ইমরান ইবনে হুসাইন রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘লজ্জাশীলতা (শুধু) কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না। (বায়হাকি)
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা : শিষ্টাচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা : ২২২) হাদিসেও বিভিন্ন উপায়ে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং নানাবিধ শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এমনকি পরিচ্ছন্নতা রক্ষাকে ঈমানের অংশ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু মালেক আশআরি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক। (মুসলিম : ২২৩)
রাগ না করে হাসিমুখে কথা বলা : রাসূলুল্লাহ সা: সর্বদা মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন এবং ক্রোধান্বিত হওয়া থেকে বিরত থাকতেন। কেননা ক্রোধান্বিত হয়ে মানুষ বেশি ভুল করে থাকে।
হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সাথে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সুতরাং ব্যক্তিজীবনে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা উচিত। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : ‘হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি : ১৯৫৬) তেমনিভাবে রাগ পরিহার করা নিয়ে হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি নবী করিম সা:-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বলেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলে নবী করিম সা: প্রত্যেকবারই বলেন, রাগ করো না। (বুখারি : ৬১১৬)
কুধারণা পরিহার করা : এক মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইয়ের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে হবে, এটাই ইসলামের শিক্ষা। মানবতার মুক্তির দূত রাসূলুল্লাহ সা:-এর মূর্তপ্রতীক। কারণ, কুধারণায় পরিবার, সংসার ও প্রতিষ্ঠান সব কিছু তছনছ হয়ে যায়। ইসলামে কুধারণা পাপ। কোনো মানুষের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা সমীচীন নয়। কেননা এতে মানুষ কষ্ট পায়। আল্লাহ বলেন : ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ।’ (সূরা হুজরাত : ১২) এ মর্মে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: হতে বর্ণিত , রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : ‘আমার সাহাবিদের কেউ যেন তাদের অপরজনের কোনো খারাপ কথা আমার কাছে না পৌঁছায়। কারণ আমি তাদের সাথে পরিষ্কার ও উদার মন নিয়েই দেখা করতে ভালোবাসি। (জামে তিরমিজি : ৩৮৯৬) সুতরাং কারো ব্যাপারে এমন কোনো কথা বলা নিষিদ্ধ, যাতে তার ব্যাপারে মন্দ ধারণা তৈরি হয়।
অন্যকে অপমানিত না করে সহমর্মী হওয়া : হাদিসের ভাষ্যমতে এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। আর ভাই-ভাইকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করবে এটাই ইসলামের শিক্ষা। এর ফলে আল্লাহর সাহায্য মিলবে। কথায় আছে, সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টা মিলে। এ মর্মে হজরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা: হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (বুখারি : ২৪৪২)
আন্তরিকতা ও নিরাপত্তা ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের বাঁকে, চলতি পথে কারো মধ্যে কোনো মন্দাচার দেখলে ব্যক্তিগতভাবে তাকে হিকমতের সাথে বলা, যাতে সে সংশোধন হয়ে যায়। অন্যকে ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। আবূ হুরারাহ রা: সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ এবং এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে। (আবু দাউদ : ৪৯১৮)। লেখক : শিক্ষার্থী, মাদরাসাতুদ দাওয়াহ্ আল-ইসলামিয়া রায়পুর, লক্ষ্মীপুর