চলতি বছরও দেশজুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। একইসাথে হাসপাতালগুলো সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে ক্রমবর্ধমান রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েছে। অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত রোববার পর্যন্ত মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩১ জনে, আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ হাজার ৩৪ জন। দুই মাস আগে সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা নিয়ে সতর্ক করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, গত কয়েক মাসের তুলনায় এখন প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাইরের।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল, ঢাকার মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ সামলাতে সাধারণ ওয়ার্ডের বাইরেও আলাদা করে সিঁড়ির কাছে রোগীদের জন্য বেডের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এসব হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত বড়দের ও শিশুদের জন্য আলাদা ফ্লোরে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব হসপিটালের চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক মাসের তুলনায় এ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। গত মাসের তুলনায় এ মাসে ক্রমাগত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর আগস্ট মাসে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার আট শ’র বেশি রোগী। আর এ মাসে এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। এখনো মাস শেষ হতে বাকি আরো সাত দিন।
চিকিৎসকরা বলেন, বেশিরভাগ রোগী ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ শক সিনড্রোম অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের ব্লাড প্রেশার কমে যাচ্ছে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কিছুটা অচল হয়ে আসছে, বমি হচ্ছে, শরীরে পানি চলে আসছে, কিছুটা ল্যাথার্জিক- এমন অবস্থা নিয়ে আসছে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ ইউএনবিকে বলেন, প্রথমত রোগীর সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। দ্বিতীয়ত গত বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যেসব কারণে, সেগুলো কিন্তু দূর হয়নি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের যে চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে, সেটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এছাড়া যেসব রোগীকে শনাক্ত করা হচ্ছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নয়, তাদের মাঠপর্যায়ে হাসপাতালে রাখার কথা, আবার যারা জটিল রোগী তাদেরও একসাথে রাখা হচ্ছে, ফলে তারা যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সব এক জায়গায় হওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। যতই ডাক্তার দেন, স্যালাইন দেন, ফ্লোরে রোগী রেখে কী সমাধান করা যায়? কাজেই চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা খুব দরকার।
তিনি জানান, অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে জেলা কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হয়। এতে মধ্যবর্তী সময়ে অনেক রোগী প্লাটিলেট কমে গিয়ে মুমূর্ষু হয়ে যায়। অন্তিম অবস্থায় চিকিৎসা পাওয়া এসব রোগীকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার ইউএনবিকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই চিকিৎসা দিতে পারে। অথচ তা না করে জেলা হাসপাতালে ট্রান্সফার করে বা বিভাগীয় হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দেয়। এতে যে সময় লাগে তাতে রোগীর প্লাজমালি কেইস হয়ে যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট কমে গিয়ে এই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নিতে হবে: অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, কিভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সেটি সবাই জানে। কিন্তু প্রতিবারই আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। প্রতিবারই বলছি, আমরা কাজ করছি, এটা করছি, সেটা করছি। কিন্তু নাগরিকরা ফলাফল পাচ্ছে না। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান বা যারা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে, তাদের চাকরি নয় বরং সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
হটস্পট ম্যানেজমেন্টের আওতায় যেসব বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে সেখানে দুই শ’ মিটারের মধ্যে ক্রাশ কর্মসূচি করতে হবে। উড়ন্ত এডিস মশা ও লার্ভা ধ্বংস করতে হবে। ফলে ওই বাড়িতে বা আশেপাশের বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হবে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ড. মহ. শের আলী ইউএনবিকে বলেন, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে ‘মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সমন্বিত উপায়ে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সারাদেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। মৃত্যু হারও বেড়েছে। যদিওবা এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে আমরা যথাযথ গুরুত্ব সহকারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মিজানুর রহমান বলেন, ‘যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি সেসব এলাকায় গতকাল রোববার থেকে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সমন্বিতভাবে বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে। এর মাধ্যমে আমরা ডেঙ্গু রোগের বিস্তার কমিয়ে আনতে সক্ষম হবো।’
উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো: মাহমুদুল হাসান ইউএনবিকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি এডিসের লার্ভা জন্মাতে পারে এমন উৎসগুলো পরিচ্ছন্ন করার মাধ্যমে ধ্বংস করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগ সম্মিলিতভাবে কাজ করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত তদারকি টিম প্রতিটি অঞ্চলে পরিচালিত কার্যক্রম সঠিকভাবে তদারকি করছে। শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে।
নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা বাসাবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করে এবং ওষুধ ছিটায়। কিন্তু বাসাবাড়ির ভেতরে আমাদের কর্মীদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয় না। তাই নিজেদের বাসাবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ফ্রিজ, এসি, ফুলের টব, অব্যবহৃত টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের খোলা প্যাকেট, বিভিন্ন ধরনের খোলা পাত্র, ছাদ কিংবা অন্য কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।’ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) থেকে একযোগে ডিএনসিসির সব ওয়ার্ডে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশা নিধন কর্মসূচি শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এই বিশেষ কর্মসূচি ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালনা করা হবে। সপ্তাহব্যাপী পরিচালিত বিশেষ মশা নিধন কর্মসূচিতে প্রতিটি ওয়ার্ডকে বিভিন্ন সাব ব্লকে ভাগ করে প্রতিটি ব্লকের সব বাড়ি পরিদর্শনের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজনন স্থল চিহ্নিত করে কীটনাশক প্রয়োগ এবং ধ্বংস করা হচ্ছে।