পৃথিবীতে শান্তি আনয়নের জন্য
পৃথিবীকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে হলে
পৃথিবীকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে
পৃথিবীকে মানুষের বাস উপযোগী করার জন্য
সর্বোপরি একটি মানবিক বিশে^র জন্য
বিশ^ নেতাদের উচিত হজরত মুহাম্মদ সা:-এর চরিতের অনুসরণ করা। দুর্ভাগ্য ও দুঃখ তাদের জন্য, যারা দেখে না, বুঝে না ইতিহাসে ঘটে যাওয়া দিবালোকের মতো স্পষ্ট একজন মানুষ এসেছিলেন নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকা জাজিরাতুল আরবের বুক চিরে, তপ্ত বালুকায় চিক চিক আলো রশ্মির ঢেউ তুলে মরু সাইমুম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:। তিনি আল্লাহর নির্দেশনায় শত শত বছরের অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুললেন। অন্ধকার দূরীভূত হলো, মানুষ জেগে উঠল একরাশ সোনালি আভায়। পথহারা মানুষ ফিরে পেলো সঠিক পথের দিশা।
রোগ হলে ওষুধ সেবন করি, ওষুধ সেবনে ওষধের উৎসমূল তথা কে কোন জাতি তা তৈরি করেছে বা ভিন্ন বর্ণ-গোষ্ঠীর চিন্তা করি না; বরং রোগ মুক্তিই হয় তখন মুখ্য উদ্দেশ্য। রাসূল সা: এমনই এক ওষুধ উদ্ভাবন করে গেছেন যার কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়া নেই। বিশ^নেতাদের কাছে অনুরোধ, রাসূল সা:-এর সেই ওষুধ অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে হলেও বর্তমান এই অশান্ত পৃথিবীতে প্রয়োগ করুন। আমি আবেগ অনুভূতিকে দূরে ঠেলে দিয়ে দ্বিধাহীন সুদৃঢ়চিত্তে এ ঘোষণা দিচ্ছি যে, পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসবে। আমি আরো বলছি, অতি স্বল্প সময়ে সমস্যা-শঙ্কুল পৃথিবী শান্তি সুখের আবাসে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হবে এবং ব্যাপক প্রাণহানিও কমে যাবে। আমরা জানি পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর শাসকরা অন্ধকার ঘরে কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে যে ভাবে টনের পর টন গোলা-বারুদ নিক্ষেপ করছে তাতে বিশাল অর্থ খরচ হচ্ছে সেই সাথে ব্যাপক প্রাণহানিও ঘটছে। ভিন্ন মতের কারণে যদি রাসূল সা:-এর মহৌষধ সেবন না-ই করেন, তবে অন্তরের গভীর প্রদেশ থেকে এই অনুরোধ করতে চাই, পৃথিবীর দেশে দেশে যারা রাসূল সা:-এর পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে খাঁটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের সহযোগিতা করুন। মনে রাখবেন, যদি রাসূল সা:-এর খাঁটি ইসলামী সমাজ গড়ে উঠে, তবে সেই সমাজের প্রতিবেশী রাষ্ট্র যারা থাকবে হোক তা ভিন্ন মতাবলম্বী, তারা পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে। বন্ধুত্ব ও প্রতিবেশীসুলভ আচরণ পূর্ণমাত্রায় বজায় থাকবে। কেউ কারো জন্য হুমকি হবে না বা কেউ কারো দ্বারা আক্রান্তও হবে না। বিশ্ব শান্তির জন্য যেটিকে হুমকি মনে করছেন, সত্যি যদি সেটি রাসূলের অনুসরণে খাঁটি ইসলামী সমাজ হয়, তবে সেটি হুমকি না হয়ে বরং কল্যাণকামী উত্তম প্রতিবেশী হবে। বিশ^শান্তির জন্য মুসলিম দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের বলুন যে, আপনারা রাসূল সা:-এর খাঁটি আদর্শে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলুন।
পৃথিবীর দেশে দেশে যারা অস্ত্রের জোরে ইসলামী সমাজ কায়েম করতে চায়, যারা রাসূল সা:-এর সহজ সরল পন্থা বাদ দিয়ে চরমপন্থা গ্রহণ করেছে তাদের দেখে রাসূল সা:-এর সামাজিক আন্দোলনকে ভুল বুঝবেন না। ইসলামে জিহাদ বা অস্ত্রের ব্যবহার ছিল যেকোনো পরিস্থিতির চূড়ান্ত ফয়সালা মাত্র। ইসলাম গোঁড়ামি ও চরমপন্থাকে কখনো সমর্থন দেয় না; বরং ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে সব প্রকার গোঁড়ামি ও চরমপন্থাকে উচ্ছেদ করে ভারসাম্যপূর্ণ কল্যাণকামী একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ও বাঁকে ভারসাম্যনীতির অনুপম শিক্ষা দিয়েছেন রাসূল সা:। তিনি মানবসমাজকে ভেতর থেকে এমনভাবে বদলে দিয়েছিলেন যে, পুরো সমাজ ও সভ্যতায় ভারসাম্য স্থাপিত হয়েছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে মানুষের মন-মগজ, চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, রীতিপ্রথা, আদত-অভ্যাস, অধিকার ও কর্তব্যের বণ্টনরীতি, ন্যায়-অন্যায়ের এবং হালাল-হারামের মানদ- বদলে গিয়েছিল। সভ্যতার একেকটি অঙ্গের ও একেকটি প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো। পরিবর্তনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত কোথাও অসঙ্গতি ও ভারসাম্যহীনতা দৃষ্টিগোচর হয় না। কোনো অংশে অকল্যাণ নেই, নেই কোনো বিকৃতি।
দুঃখের বিষয়, যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সামাজিক মর্যাদার এই সুউচ্চ মাপকাঠি এবং সামাজিক জীবনের এই সুমহান লক্ষ্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না, তারাই কেবল চরমপন্থার সঙ্কীর্ণ রাস্তা ধরে চলে।
তবে এখানে এ কথাটি বলে রাখি, যারা রাসূল সা:-এর সমাজ বিপ্লবের সুমহান পথ পরিহার করে সঙ্কীর্ণতার পথে পা বাড়িয়েছে, তাদের এ বিপথগামিতার ৯০ শতাংশ দায়ী বিশ্ব নেতারা। রাসূল সা:-এর পূর্ণ অনুসরণে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় যখনই কোনো আন্দোলন শুরু হয়, তাদের ওপর নেমে আসে রাজ্যের খড়গ। আর তাদের দমন প্রক্রিয়ায় পূর্ণোদ্দমে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বিশ্ব নেতারা।
আমি ১০ শতাংশ দোষ দিতে চাই চরমপন্থীদেরকে এই কারণে যে, আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোনো দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয় যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো। এটি আল্লাহভীতির সাথে বেশি সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তার খবর রাখেন’ (সূরা মায়েদা-৮)।
ইসলাম, মুসলমান ও মুসলিম উম্মাহ মধ্যমপন্থী জাতি। তাদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা আল্লাহ দিয়েছেন-
‘রহমানের (প্রকৃত) বান্দাহ তারা- যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রতার সাথে চলাফেরা করে, আর জাহেল লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে এলে বলে দেয় যে, তোমাদের সালাম। যারা নিজেদের রবের সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে রাত কাটায় এবং যারা এই বলে দোয়া করে যে, হে আমাদের রব, জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করো। জাহান্নামের আজাব তো প্রাণান্তকর। নিশ্চয়ই বিশ্রামস্থল এবং বাসস্থান হিসেবে তা অত্যন্ত জঘন্য এবং যারা খরচের বেলায় বেহুদা খরচ কিংবা কার্পণ্য করে না; বরং দুই সীমার মাঝামাঝি মধ্যম নীতির উপর দাঁড়িয়ে থাকে’ (সূরা ফুরকান : ৬৩-৬৭)।
‘তোমার চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর খাটো করো’ (সূরা লোকমান- ১৯)।
‘লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না, আর গর্বভরে জমিনে হাঁটা-চলা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না’ (সূরা লোকমান-১৮)।
‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে’ (সূরা ইমরান-১১০)।
রাসূল সা: মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনকে সুষমনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আল্লাহর নির্দেশিত পথে কর্মসূচি প্রণয়ন করেছেন, যে কর্মসূচিগুলো মানুষকে উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল, মানব-দরদি, দানশীল ও পারস্পরিক কল্যাণকামী সর্বোপরি একটি ভারসাম্যপূর্ণ জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সামষ্টিকভাবে কাজ করে থাকে। যে সমাজে ভ্রাতৃত্ব বোধ প্রবল হবে সেখানে অতিউৎসাহী, অতিমানবীয় কোনো কাজকর্ম থাকতে পারে না। মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে জীবনের সামগ্রিক ব্যাপারে ভারসাম্য সৃষ্টি এবং ন্যায় ও ইনসাফের জন্য অগ্রসর হওয়া প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের বিশে^র নেতারা ও প্রতিটি দেশের শাসকদেরকে আবারো বলছি, সত্যিই আপনারা যদি বিবেকের সাথে প্রতারণায় লিপ্ত না হন, সত্যি সত্যিই পৃথিবীতে বা প্রত্যেকের সংশ্লিষ্ট দেশে সার্বিক শান্তি আনতে চান এবং পৃথিবীকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত করতে চান, যা কোনোক্রমেই পারছেন না, খুব দ্রুত রাসূল সা:-এর আদর্শের কাছে ফিরে আসুন।
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক