শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩২ অপরাহ্ন

লোকমান হাকিম ও রোমানদের যুদ্ধজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী

আবু আশফাক মুহাম্মাদ
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কোরআনের সুরা আনকাবুতের ৪৫ থেকে সুরা রুম, সুরা লোকমান, সুরা সাজদা ও আহজাবের ১ থেকে ৩০ নম্বর আয়াত এবং ২১তম পারা ।।অংশে মাতৃভূমি ত্যাগ, সামাজিক শিষ্টাচার, কোরআন অস্বীকারের পরিণাম, নামাজের উপকারিতা, ধৈর্য, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, সুদ, সন্তানের প্রতি লোকমান (আ.)-এর উপদেশ, পাঁচ জিনিসের জ্ঞান, পালক পুত্রের বিধান, নবীপতœীদের প্রতি নির্দেশ, দ্বীনের পথে বিপদ, ভ্রমণ, বাতাস, মুমিন ও কাফেরের অবস্থা, ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি, মুমিনের পুরস্কার, নবীদের জীবন উম্মতের আদর্শ, দুনিয়ার মায়া ত্যাগ, জাকাত ইত্যাদি বর্ণনা রয়েছে।
নামাজের উপকারিতা: নামাজের উপকারিতার কথা বর্ণনার মধ্য দিয়ে সুরা আনকাবুতের ৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ এই আয়াত নাজিল হলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে’—এর অর্থ কী? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তিকে নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে না, তার নামাজ কিছুই নয়।’
তাফসিরকারদের মতে, এই আয়াতের মর্ম হলো, পরিপূর্ণ মনোযোগ ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে তাকবির থেকে শুরু করে দাঁড়ানো, অর্থ বুঝে তিলাওয়াত, রুকু, সিজদা ও বৈঠক করা হলো নামাজ। আল্লাহর কাছে নিবেদিত হয়ে যে নামাজ পড়া হয়, তা ব্যক্তিকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে। অনেককে দেখা যায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে নফলও পড়ছেন কিন্তু সুদ গ্রহণ করছেন, ঘুষ নিচ্ছেন, প্রতিবেশীর হক নষ্ট করছেন, আত্মীয় ও উত্তরাধিকারীদের ঠকাচ্ছেন! তাঁরা নামাজ পড়ছেন ঠিকই, নামাজে একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতা নেই। আল্লাহপ্রেম নেই।
পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে চির ও অনড় সত্য হলো মৃত্যু। মৃত্যু অবধারিত। যে জন্মেছে, সে মরবেই। মৃত্যু ভুলে থাকা যায়, এর থেকে পালিয়ে বেড়ানো যায় না। জন্মের পর বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক, মৃত্যু স্বাভাবিক। পৃথিবীতে জীবিত ব্যক্তিদের চেয়ে মৃতের সংখ্যাই বেশি। জগতে একমাত্র আল্লাহই চিরঞ্জীব। তিনি ছিলেন, এখন আছেন এবং থাকবেনও। তিনি ছাড়া সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের উচিত, সব সময় মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে থাকা। আল্লাহ খুশি হয়ে যায়, এমন কাজ করা।
আল্লাহ বলেন, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমরা আমার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৫৭)
সুরা রুমে রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী: ৬০ আয়াতবিশিষ্ট সুরা রুম মক্কায় অবতীর্ণ। এটি কোরআনের ৩০তম সুরা। এই সুরার শুরুতে পারসিকদের বিরুদ্ধে রোমানদের যুদ্ধজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
তখন ৬০৩ খ্রিষ্টাব্দ। রোমানরা পারসিকদের কাছে লাগাতার যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছিল। পারসিকদের বিজয়ে মক্কার অবিশ্বাসীরা খুশিতে নেচে ওঠে। মুসলমানদের মন ভাঙে। পারসিকরা ছিল অগ্নিপূজক। রোমকরা ছিল আসমানি কিতাবে বিশ্বাসী। এ সময় কোরআনে আয়াত নাজিল হয়, কয়েক বছরের মধ্যেই রোমানরা বিজয়ী হবে। কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আবু বকর (রা.) খুশিতে মক্কার চারপাশে এ ঘোষণা দিলেন। অবিশ্বাসীরা ঠাট্টা করল।
উবাই ইবনে খলফ আবু বকরকে মিথ্যাবাদী বলল। আবু বকর বললেন, ‘তিন বছরের মধ্যে রোমকরা বিজয়ী না হলে আমি তোমাকে ১০টি উট দেব।’ উবাই রাজি হলেন। জুয়া তখনো হারাম হয়নি।
আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ঘটনা শোনালেন। তিনি বললেন, ‘আমি তো তিন বছর নির্দিষ্ট করেনি। এটা ৩ থেকে ৯ বছরের মধ্যে ঘটতে পারে। তুমি উবাইকে বলো, ১০টি উটের পরিবর্তে ১০০ উট দেব, তবে সময়কাল ৩ থেকে ৯ বছর।’ উবাই আবু বকরের প্রস্তাবে রাজি হলেন। (ইবনে জারির, তিরমিজি)
হাদিস থেকে জানা যায়, হিজরতের পাঁচ বছর আগে এই ঘটনা ঘটে এবং সাত বছরে পূর্ণ হওয়ার পর বদর যুদ্ধের সময় রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃ. ১, ০৩৭)
স্বামী-স্ত্রীর সম্প্রীতি: সুরা রুমের ২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনের মধ্যে হলো এই যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ নারী পুরুষের সঙ্গিনী। নারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত পুরুষের সব প্রয়োজনের সারমর্ম হচ্ছে মানসিক শান্তি ও সুখ। বৈবাহিক জীবনের নির্যাসও মনের শান্তি ও সুখ। পারস্পরিক শান্তি তখনই সম্ভব, যখন নারী-পুরুষের সম্পর্কের ভিত্তি শরিয়াহসম্মত বিয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। একে অপরের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকবে এবং তা আদায় করবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আল্লাহ তাআলাই ভালোবাসা ও হৃদ্যতা ঢেলে দেন। পরস্পরের প্রতি মায়া সৃষ্টি করেন। অন্যথায়, অপরিচিতি দুজন মানুষ প্রথম দিন থেকেই এত আন্তরিক আর অন্তরঙ্গ কখনো হতে পারত না।
কোরআনের ৩১তম সুরা লোকমান মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াতের সংখ্যা ৩৪। এই সুরায় লোকমান হাকিমের কিছু প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ থাকায় এর নাম রাখা হয়েছে সুরা লোকমান। লোকমান ছিলেন ধার্মিক ও জ্ঞানী। আল্লাহ তাঁকে প্রজ্ঞা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি নবী ছিলেন না।
ছেলের প্রতি লোকমানের ১২ উপদেশ: সুরা লোকমানের ১২ থেকে ১৯ নম্বর আয়াতে সন্তানের প্রতি লোকমান হাকিমের ১২টি উপদেশের বর্ণনা রয়েছে। যেমন এক. শিরক কোরো না। দুই. মা–বাবার সঙ্গে ভালো আচরণ কোরো। তিন. তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করতে বললে তাঁদের কথা গ্রহণ কোরো না। চার. আল্লাহর জিকির কোরো। পাঁচ. নামাজ কায়েম কোরো। ছয়. ভালো কাজে আদেশ দাও। সাত. মন্দ কাজ থেকে নিষেধ কোরো। আট. বিপদে ধৈর্য ধারণ কোরো। নয়. মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না। দশ. গর্বভরে চলাফেরা কোরো না। এগারো. মধ্যপন্থা অবলম্বন কোরো। এবং বারো. কণ্ঠস্বর নিচু রেখে জীবন যাপন কোরো।
সুরা সাজদা ও আহজাবের বিষয়বস্তু: মক্কায় অবতীর্ণ সুরা সাজদার আয়াতের সংখ্যা ৩০। এটি কোরআনের ৩২তম সুরা। ৭৩ আয়াতবিশিষ্ট সুরা আহজাব মদিনায় অবতীর্ণ। কোরআনের ৩৩তম সুরা এটি। এ দুই সুরায় কোরআনের মহত্ত্ব, আল্লাহর একত্ববাদ ও কুদরত, মানুষ সৃষ্টির বিবরণ, বিশ্বাসীদের ইবাদত, আখেরাতে তাদের পুরস্কার, কিয়ামত, সামাজিক শিষ্টাচার, আল্লাহর বিধান, যুদ্ধসহ অন্যান্য বিষয়ের আলোচনা রয়েছে। লেখক: আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com