পরনির্ভরশীল, অকর্মা, অলস, কুড়ে লোকের স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম সবসময়ই এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছে। কোনো নবী-রাসূল পরনির্ভরশীল ছিলেন না। সবাই পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। মূলত আত্মকর্মসংস্থানহীন লোকের মাধ্যমে সমাজে, দেশে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অনৈতিক কাজ হয়ে থাকে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আখড়া। যেহেতু একজন মানুষের বাঁচার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির প্রয়োজন হয় তাই অকর্মা লোকরা অর্থের সংস্থানের জন্য সমাজে অনৈতিক কাজ করে থাকে। কর্মক্ষম ব্যক্তির বসে থাকা ঠিক নয় : এক দিকে দেশের জনগণের আত্মকর্মসংস্থান করে দেয়ার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আত্মকর্মসংস্থান করে নেয়াও নৈতিক দায়িত্ব। আমরা বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাবো লাখো কর্মক্ষম বেকার যুবক বসে আছে। অথচ তাদের চাহিদা কিন্তু থেমে নেই। চাহিদা পূরণের জন্য তারা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি-রাহাজানি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি তাদের নিত্যদিনের কার্যসূচিতে পরিণত হয়েছে। যেহেতু তাদের পরিশ্রমলব্ধ টাকা নয় তাই টাকাগুলোও ব্যবহার হচ্ছে অনৈতিক কাজে। মদ, জুয়া, হাউজি, নারীবাজি ইত্যাদিসহ সব অসামাজিক কাজে তারা ব্যবহার করছে কালো টাকা। এসব শিক্ষিত বেকার যুবক সাময়িকভাবে ডিগ্রি অর্জনের অহঙ্কার ত্যাগ করে যদি নিজেরা আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নেয়ার চেষ্টা করত, বসে না থেকে ব্যবসা বা কৃষি যেকোনো কাজে আত্মনিয়োগ করত, তাহলে দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেও সচ্ছল হতো। এ ব্যাপারে রাসূল সা: বলেছেন, দান-খয়রাত গ্রহণ করা কোনো ধনী লেকের জন্য জায়েজ নয়, শক্তিমান ও সুস্থ ব্যক্তির জন্যও জায়েজ নয়। (তিরমিজি)
মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হয়, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহ (জীবিকা) থেকে অন্বেষণ করো। (জুমা ১০) উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, অকর্মা হয়ে বসে থাকা ইসলামে জায়েজ নেই। ভিক্ষাবৃত্তি ইসলামে জায়েজ নেই : উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম। রাসূল সা: বলেছেন, মহান আল্লাহর কাছে হালাল কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বা রাগের উদ্রেক সৃষ্টিকারী কাজ হলো স্ত্রীকে তালাক দেয়া, ভিক্ষাবৃত্তি করা। (আল হাদিস) যারা ভিক্ষাবৃত্তি করে তারা অসম্মানজনক, অবহেলিত ও তুচ্ছ জীবন যাপন করে। কোনো মুসলমান অপর কারো কাছে হাত প্রসারিত করলে তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিলীন হয়ে যাবে এবং স্বীয় মনুষ্যত্বের মানমর্যাদা অকারণে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নবী করীম সা: এ ব্যাপারে কঠিন ও কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষা চায়, সে নিজ হস্তে অঙ্গার একত্রিত করার মতো ভয়াবহ কাজ করে। (বায়হাকি ইবনে খুজাইমা) রাসূল (সা:) আরো বলেন, ‘যে লোক ধনী হওয়ার উদ্দেশ্যে লোকদের কাছে ভিক্ষা চাইবে সে নিজের চেহারাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য ক্ষতযুক্ত করে দিলো। সে জাহান্নামের গরম পাথর ভক্ষণ করতে বাধ্য হবে। এখানে যার ইচ্ছা নিজের জন্য এসব জিনিস বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করুক আর যার ইচ্ছা কম করুক।’
আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপারে নবী-রাসূল সা:-এর জীবনী থেকে দৃষ্টান্ত : আল কুরআন, আল হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই, কোনো নবী-রাসূল অলস বা নিষ্কর্মা ছিলেন না। হাদিসে এসেছে রাসূল সা: বলেছেন, হজরত দাউদ আ: নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। (বুখারি) অন্য হাদিসে আছে- হজরত জাকারিয়া আ: ছিলেন একজন ছুতার বা কাঠমিস্ত্রি। মুস্তাদরাকে হাকেমে হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত আছে যে, হজরত আদম আ: কৃষিকাজ করতেন, হজরত নূহ আ: কাঠমিস্ত্রি ছিলেন, হজরত ইদ্রিস আ: কাপড় সেলাই করতেন, হজরত মূসা আ: রাখালের কাজ করতেন। অন্য একটি হাদিসে এসেছে- রাসূল সা: বলেছেন, এমন কোনো নবী-রাসূল ছিলেন না যিনি বকরি বা ছাগল চরাননি। তা ছাড়া রাসূল সা: নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাসূল সা: ইহুদির কূপ থেকে খাদ্যের বিনিময়ে পানি তুলে দিয়েছেন। ব্যবসা পরিচালনা করেছেন-ছাগল চরিয়েছেন।
বিভিন্ন কাজে শ্রম দিয়েছেন। সুতরাং কাজ না করে বসে থাকার কোনো অবকাশ অন্য ধর্মে থাকলেও ইসলামে নেই। নবী-রাসূল সা: আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন সেখানে কেন আমরা অপরের গলগ্রহ বা অকর্মা, নিষ্কর্মা পরজীবী হয়ে জীবন যাপন করব? কোনো বিবেকবান মানুষ অকর্ম হয়ে বসে থাকতে পারে না।
জীবিকা উপার্জনে উৎসাহ প্রদান : রাসূল সা: এরশাদ করেছেন, নিজ হতে উপার্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। অপর একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ওই ব্যক্তিই উত্তম যে নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে। জনৈক সাহাবি রাসূল সা:-এর কাছে ভিক্ষা চাইতে এলে রাসূল সা: তাকে ভিক্ষা না দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের উপায় বাতলিয়ে দেন। সাহাবায়ে কেরাম রা: ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। সবাই নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকেননি। নবী-রাসূল সা: সবাই ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। সবাই নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাজ যত ক্ষুদ্র হোক না কেন তারা তা করতেন। কোনো কাজকে অবহেলা করতেন না। বৈধ যেকোনো কাজ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। ভিক্ষাবৃত্তি বা পরজীবী হিসেবে জীবনযাপনকে শুধু নিরুৎসাহিতই করেননি; বরং ঘৃণা করেছেন। লেখক : চিকিৎসক, কলামিস্ট