মহানবী সা: কুরআনের আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা কায়েম করেছেন। কুরআন প্রবর্তিত বিধানই ছিল রাসূল সা:-এর আদর্শের মূল ভিত্তি। তিনি এমন কোনো কথা বলেননি বা এমন কোনো কাজ করেননি, যার পক্ষে কুরআনের সমর্থন নেই। আর কুরআন হলো আল্লাহর বাণী। তাই নবীজী সা:-এর আদর্শ মানেই কুরআনের আদর্শ। মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সা: দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক জীবন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহ করার জন্য মানুষের জীবনের বিরাট অংশ দখল করে আছে অর্থনৈতিক কর্মকা-। চাষাবাদ, গৃহস্থালি, কৃষি, চাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য, কর, রাজস্ব ইত্যাদি কর্মকা- ছাড়া জীবন পরিচালনা যে সম্ভব নয়, আমরা তা অনুধাবন করি। তাই তো প্রত্যেক নবী-রাসূল জীবনে মেষ পালন, কৃষিকাজ বা ব্যবসায় ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সা: ছেলেবেলায় মেষ চরানো থেকে পরিণত জীবনে এসে ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। সাহাবিদের অধিকাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। ফলে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন আদর্শ বিধান কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রবর্তিত হয়েছে। মহানবী সা: প্রবর্তিত এবং কুরআন নির্দেশিত সেই মহান আদর্শ নিয়েই এ প্রবন্ধের আলোচনার বিষয়।
সম্পদের মালিকানার বিধান: মহানবী সা: মদিনায় যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তখন তিনি একটি টেকসই এবং সুবিন্যস্ত অর্থ প্রশাসনও কায়েম করেছিলেন। আর এই অর্থব্যবস্থার মৌলিক দর্শন হলো, পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের মালিকানা আল্লাহর। তাই অর্থসম্পদ যে-ই অর্জন করুক না কেন, তাতে তার অধিকার থাকলেও সেই অধিকার প্রযোজ্য হবে আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে। মানুষ কেবল সম্পদের আমানতদার হিসেবে আল্লাহর সম্পদ উপার্জন, সংরক্ষণ এবং ভোগ করবে। কারণ আল্লাহ মানুষের কল্যাণেই পৃথিবীর সম্পদ সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা বাকারাহ-২৯) সম্পদ উপার্জনের নীতিমালাও আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে-অপরের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ (সূরা বাকারাহ-১৮৮) সম্পদ অর্জন এবং ব্যয় সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা: আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি এক হাদিসে বলেন, ‘কিয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের পা একবিন্দু নড়তে পারবে না। এর একটি হলো তার সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে।’ (সুনানে তিরমিজি)
অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা : রাসূল সা: প্রবর্তিত অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সুবিচার কায়েম করা। এ বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হলো, মানুষ বৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অধিকার লাভ করবে, তেমনি তা অর্জনে শোষণ ও জুলুমের পথ পরিহার করবে। অর্থাৎ অর্থ উপার্জন ও ব্যয় হবে ন্যায়নিষ্ঠ এবং শোষণ ও জুলুমমুক্ত। ইসলামের অর্থব্যবস্থাপনা হবে সুবিচারপূর্ণ। অন্যের অকল্যাণ হবে এ কারণে মানুষ সম্পদ জমিয়ে রাখতে পারবে না। আর তা হবে অবিচারের শামিল। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।’ (সূরা তাওবাহ-৩৪) আল্লাহ আরো বলেন, ‘আল্লাহর পথে ব্যয় করো, আর নিজেদের হাতেই নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ-ইহসান করো। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারাহ : ১৯৫) ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অপচয়, অপব্যয়ের মতো অনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ, কেননা তা সুবিচারের পরিপন্থী। আল্লাহ বলেন, ‘অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনআম : ১৪১) বঞ্চিত ও অভাবীদের অধিকার সংরক্ষণ : রাসূল সা: মদিনা রাষ্ট্রে যে অর্থ ব্যবস্থাপনা চালু করেছিলেন, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বঞ্চিত, অভাবী ও এতিমের অধিকার প্রতিষ্ঠা। সম্পদশালীদের সম্পদে আল্লাহ সম্পদহীন ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘এবং তাদের (ধনীদের) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা যারিয়াত : ১৯) অভাবী ও ভিক্ষুকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী অর্থনৈতিক নির্দেশনা অনন্য। আল্লাহ বলেন, ‘ভিক্ষুক প্রার্থীকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়ো না।’ (সূরা দোহা : ৯) ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি নজর দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন মহানবী সা:। তিনি বলেছেন, ‘সর্বোত্তম সাদাকা এই যে, তুমি কোনো ক্ষুধার্তকে তৃপ্তিসহকারে খাওয়াবে।’ (মিশকাত)। এভাবে মহানবী সা: মদিনায় কায়েম করেছিলেন এমন একটি সমাজ যেখানে একসময় জাকাত গ্রহণ করার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। নবীজী সা:-এর সাহাবিরাও আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে এমন অর্থব্যবস্থার নজির স্থাপন করেছিলেন, যার ফলে মদিনা একটি সুখী ও কল্যাণময় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। (চলবে)