(গত দিনের পর)
সম্পদ সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা : দুনিয়ার তাবত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুষম বণ্টনের স্লোগান তুললেও প্রতিটি ব্যবস্থা শোষণ, পীড়ন ও লুণ্ঠনের পথকেই সুগম করেছে। এসব (পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র) ব্যবস্থায় ধনী ক্রমেই ধনী হয়েছে। গরিবরা দিন দিন আরো খারাপ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। এর ফলে দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত চলছে মানুষের সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত লড়াই। অথচ ইসলাম সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। রাসূল সা: প্রবর্তিত ব্যবস্থায় অর্থসম্পদ শুধু ধনীদের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই; বরং তা সম্পদহীন মানুষের কাছে প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘ধনসম্পদ শুধু তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই যেন পুঞ্জীভূত না হয়।’ (সূরা হাশর : ৭) মহান আল্লাহ মানুষকে অনুগ্রহ করে যে ধনসম্পদ দান করেন, তা যেন সবার কাছে যেতে পারে, অভাবী ও প্রার্থীর চাহিদা পূরণ করতে পারে, তার নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের সম্পদে হক নির্ধারিত রয়েছে প্রার্থী-অপ্রার্থী (যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতের) নির্বিশেষে সবার।’ (সূরা মা’আরিজ : ২৪-২৫) সম্পদ প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমিই বণ্টন করে রেখেছি তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে এবং তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, যাতে একে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে।’ (সূরা যুখরুফ : ৩২) সম্পদকে ত্বরিৎ হকদারের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য মহানবী সা: ছিলেন সবচেয়ে অগ্রসর। এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যদি ওহুদ পরিমাণ স্বর্ণ থাকত, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার (বণ্টনের) পর তার কিছু অংশ আমার কাছে থেকে যাক, তা আমি ভালো মনে করতাম না।’ (সহিহ বুখারি)
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকা- নিষিদ্ধ : অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং যাবতীয় অনৈতিকতা ও অপরাধ বন্ধ করা ছিল রাসূল সা: প্রতিষ্ঠিত অর্থব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য ইসলামে মজুদদারি, প্রতারণা, ওজনে কম দেয়া, মিথ্যা শপথ করে খারাপ জিনিস বিক্রি, কাউকে ঠকানো এবং অর্থ পাচার বা সম্পদ আত্মসাৎ এসব কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা সুবিচারের জন্য অপরিহার্য। অন্যের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করাকে আল্লাহ তায়ালা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না (আত্মসাৎ করো না)।’ (সূরা আন-নিসা : ২৯) এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘আর যে তোমার আমানত (সম্পদ) আত্মসাৎ করেছে, তুমি তার আমানত আত্মসাৎ করো না।’ (আবু দাউদ) অর্থ ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা সৃষ্টি এবং সম্পদকে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার জন্য মজুদদারির আশ্রয় নেয়া হয়। এটি ইসলামে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য মজুদ (গুদামজাত) করে রাখে, সে অপরাধী।’ (মুজামুল কাবির) অন্যত্র রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ)। ছলচাতুরী বা প্রতারণা করা অথবা কাউকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সুব্যবস্থাপনার জন্য এসব কাজ খুবই ক্ষতিকর। রাসূল সা: বলেন, ‘এমন কিছু মানুষ আছে, যারা আল্লাহর বান্দাদের সম্পদে অন্যায়ভাবে ছলচাতুরীর (প্রতারণা) মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করে। কেয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। (সহিহ বুখারি) ব্যবসা-বাণিজ্যের বেলায় ওজনে কম দিয়ে কাউকে ঠকানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার কওম! মাপ ও ওজন পূর্ণ করো ইনসাফের সাথে এবং মানুষকে তার পণ্য কম দিয়ো না।’ (সূরা হুদ : ৮৫) এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের জন্য, যারা মাপে বা ওজনে কম দেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
কেন্দ্রীয় অর্থভা-ার হিসেবে বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা : মদিনা রাষ্ট্র কায়েমের পর মহানবী সা: যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তার অন্যতম হলো বায়তুলমাল। মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনার খরচ নির্বাহ, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয় পূরণ এবং জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য বায়তুলমাল ছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগার। ‘মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করেই মূলত বায়তুলমালসহ রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো।’ (ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ১৯৯৪, খ–১৫, পৃ. ৫৯৫) প্রসঙ্গত, বায়তুলমালের সব কার্যক্রম রাসূলের সা: সরাসরি তদারকিতে পরিচালিত হতো।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২) বায়তুলমালের আয়ের উৎসগুলো ছিল- (ক) জাকাত, (খ) উশর, (গ) সদাকাতুল ফিতর, (ঘ) ওয়াকফ, (ঙ) গণিমত, (চ) আল-ফাই, (ছ) মুক্তিপণ, (জ) উপহারসামগ্রী, (ঝ) জিজিয়া, (ঞ) খারাজ, (ট) নাওয়াইব, (ঠ) আমওয়াল আল-ফাদিলা, (ড) দান-খয়রাত, (ঠ) কর্জ। (ইকোনমিক অ্যান্ড ফিসক্যাল সিস্টেম ডিউরিং দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ সা:)। (চলবে)