রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৩৩ পূর্বাহ্ন

অর্থনীতিতে মহানবী সা: আদর্শ-৪

ড. ইকবাল কবীর মোহন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪

(গত দিনের পর)
ঝ. জিযিয়া : ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা জীবন ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তার জন্য যে নির্দিষ্ট কর প্রদান করে থাকে তাকে জিযিয়া বলা হয়। মদিনা রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপ করা হয়েছিল। জিযিয়া মূলত নিরাপত্তামূলক সামরিক কর হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন সামরিক বাহিনীতে মুসলিম নাগরিকদের যোগদান করা ছিল বাধ্যতামূলক। পক্ষান্তরে অমুসলিম নাগরিকদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই তাদের ওপর জিযিয়া কর ধার্য করা হতো। কুরআনে জিযিয়া করের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যাদের প্রতি কিতাব নাজিল হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে না আল্লাহর প্রতি, আখিরাতের প্রতি এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন, তা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দীন অনুসরণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া দেয়।’-(সূরা তাওবা : ২৯)
জিযিয়া ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করার কারণে অমুসলিমদের ওপর ধার্যকৃত খাজনা বিবেচিত হতো না। কেননা দরিদ্র অমুসলিমদের কাছ থেকে জিযিয়া নেয়া হতো না। এ ছাড়া শিশু, মহিলা, পঙ্গু, অসহায়, ধর্মপ্রচারক প্রমুখের কাছ থেকেও জিযিয়া নেয়া হতো না। সামর্থ্যবান পুরুষদের কাছ থেকে প্রতি বছর এক দিনার জিযিয়া আদায় করা হতো। প্রসঙ্গত যেসব অমুসলিম সামরিক বাহিনীতে যোগদান করত, তাদের জিযিয়া প্রদানের প্রয়োজন ছিল না। জিযিয়া থেকে যে অর্থ আয় হতো, তা বায়তুলমালে জমা হতো এবং সামরিক বাহিনীর কল্যাণে ব্যয় করা হতো।
ঞ. খারাজ : খারাজ অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা ভূমি কর। মদিনা রাষ্ট্রের রাজস্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল খারাজ বা ভূমি কর। অমুসলিম কৃষিজীবী নাগরিকদের ওপর রাসূল সা: এই কর ধার্য করেন। শরি’য়াহর দৃষ্টিতে কোনো জমি খারাজি হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার ওপর খারাজ বা ভূমিকর ধার্য করা জরুরি শর্ত। খায়বর বিজয়ের পর মহানবী সা: সর্বপ্রথম সেখানকার ইহুদিদের ওপর খারাজ ধার্য করেন। প্রসঙ্গত ইহুদিরা ইসলামী রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করে ও খারাজ প্রদানের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি ভূমি চাষাবাদের অধিকার লাভ করে। ইসলামী রাষ্ট্র ও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাঝে আলোচনাসাপেক্ষে খারাজের অংশের পরিমাণ নির্ধারণ করা হতো। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মালিকপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হতো। খারাজের যাবতীয় অর্থ মহানবী সা: সৈনিকদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।
ট. নাওয়াইব : রাষ্ট্রের জরুরি ব্যয় নির্বাহের জন্য বিত্তবান মুসলিমদের কাছ থেকে যে দান গ্রহণ করা হয়, তাকে নাওয়াইব বলা হয়। যেমন, তাবুক যুদ্ধের আগে মহানবী সা: ধনী সাহাবাগণের নিকট থেকে এ ধরনের দান গ্রহণ করেছিলেন। মহানবীর সা: ঘোষণার পর মুসলমানরা তাতে তাৎক্ষণিক সাড়া দেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে সম্পদের স্তূপ গড়ে ওঠে। আবু বকর (রা) সর্বস্ব নিয়ে আসেন এবং তা পরিমাণে ছিল ৪০০০ (চার হাজার) দিরহাম। উমর (রা) তার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে আসেন। উসমান (রা) সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশের ব্যয়ভার বহন করেন। বালাযুরি বলেন, উসমানের (রা) সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার দিরহাম।
ঠ. আমওয়াল আল-ফাদিলা : উত্তরাধিকারীবিহীন কোনো মুসলিমের সম্পত্তি বা ওয়ারিসবিহীন সম্পত্তি, ধর্মত্যাগী ও পলাতক ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে প্রচুর অর্থ আহরণ হতো। আর তা বায়তুলমালে জমা হতো। এগুলো আমওয়াল আল-ফাদিলা নামে পরিচিত।
ড. দান-খয়রাত : প্রয়োজনের দাবি মেটাতে সময়মতো দান-খয়রাতকে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। এটি মদিনা রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। প্রসঙ্গত মহানবী সা: একবার নও-মুসলিমদের সাহায্যের জন্য আহ্বান জানালে সবাই তাদের সাহায্যে ছুটে আসেন। কেউ খাদ্য, কেউ কাপড় এবং কেউ কেউ বিপুল অর্থ নিয়ে আসেন। দান-খয়রাত জাকাতের মতো অপরিহার্য নয়। তারপরও ইসলাম তা অব্যাহত রাখার জন্য বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা দেয়। দান-খয়রাত উত্তোলন ও বণ্টন উভয়বিধ কাজ মহানবী সা: নিজ হাতেই করতেন। বায়তুলমালে দান-খয়রাত খাতে যে বিপুল অর্থ আদায় হতো, তা যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) তত্ত্বাবধান করতেন।
ঢ. কর্জ বা ধার : মহানবী সা: মক্কা বিজয়ের পর প্রয়োজনে কর্জ বা ঋণ গ্রহণ করেন। হাওয়াজিন যুদ্ধের আগে মহানবী সা: আবদুল্লাহ ইবনে রবীয়ার কাছ থেকে ৩০,০০০ (এিশ হাজার) দিরহাম ঋণ গ্রহণ করেন। অপর একটি সূত্রে ২০,০০০ (বিশ হাজার) দিরহামের কথা উল্লেখ আছে। হুনাইনের যুদ্ধের সময় মহানবী সা: সাফওয়ান নামক এক অমুসলিমের কাছ থেকে ৫০টি বর্ম ধার করেন। এই কর্জ, ধার বা ঋণ বায়তুল মালের সাময়িক উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো।
এভাবে অর্থব্যবস্থার অনেক আদর্শ মহানবী সা: প্রচলন করেন। এগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যয়ভার বহন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। মুসলিম সমাজ ও দেশের কল্যাণে নবীজির সা: আদর্শ অর্থব্যবস্থা অনন্য উচ্চতা লাভ করে। (শেষ) লেখক : ডিএমডি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com