আল্লাহ তায়ালার দরবারে অসংখ্য, অগণিত শুকরিয়া, তিনি আমাদেরকে ১৪৪৬ হিজরির শাবান মাসে উপনীত করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর দরবারে প্রত্যাশা রাখি পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তি-নিরাপত্তা, সুস্থতা ও আমলের সাথে মাহে রমজান অতিবাহিত করতে পারব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশি বেশি সালাফ বা পূর্বসূরিদের ন্যায় এই দোয়া করতে থাকব। মুআল্লা ইবনুল ফজল বলেন, ‘তারা (সালাফগণ) আল্লাহর কাছে ছয় মাস দোয়া করতেন, তিনি যেন তাদের রমজান পর্যন্ত উপনীত করেন এবং বাকি ছয় মাস দোয়া করতেন যেন, (রমজানের ইবাদত-বন্দেগি) কবুল করেন।’
এটি আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নিয়ামত। একজন মুমিনের ঈমানি কর্তব্য হলো- আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। এই শুকরিয়া আদায়ের একটি মাধ্যম এবং প্রকাশ হলো- আল্লাহর দেয়া নিয়ামত আল্লাহর হুকুম ও সন্তুষ্টি মোতাবেক ব্যবহার করা।
একটি বছর যায়, একটি বছর আসে। একটি রমজান যায়, একটি রমজান আসে। এভাবে জীবনও একদিন ফুরিয়ে যাবে, আমি উপনীত হবো জীবনের শেষ রমজানে; যে রমজানের পর আর রমজান আসবে না আমার জীবনে। কিন্তু আমি জানি না কোন রমজান আমার জীবনের শেষ রমজান। হয়তো এই রমজান…! আসুন, রমজানের যথাযথ কদর করি। সামনে দীর্ঘ বন্ধুর পথ, পাথেয় সংগ্রহের এখনই সময়! সৌভাগ্যবান ব্যক্তি তো সে, যে প্রতিটি রমজানেরই যথাযথ কদর করল এবং আল্লাহর দেয়া মূল্যবান মুহূর্তগুলো থেকে অধিকতর ঈমানি-রূহানি ও পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করল। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শুরু করার পূর্বশর্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা। যার প্রস্তুতি যত ভালো হয়, তার রেজাল্ট ও তত ভালো হয়ে থাকে। কিভাবে রমজান পূর্ববর্তী শাবান মাস ফলপ্রসূ হতে পারে বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
শাবান মাসে রাসূলুল্লাহ সা:-এর আমল : আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, নবী সা: রমজান ছাড়া শাবান মাসে সর্বাধিক রোজা রাখতেন। আয়েশা রা: বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে পূর্ণ মাস রোজা রাখতে দেখিনি। আর আমি তাঁকে (রমজান ছাড়া) শাবান মাস অপেক্ষা অধিক রোজা রাখতে আর কোনো মাসে দেখিনি।’ (বুখারি-১৯৬৯)
আয়েশা রা: থেকেই বর্ণিত অপর এক হাদিসে আছে, ‘রোজা রাখার জন্য নবী সা:-এর কাছে সর্বাধিক প্রিয় মাস ছিল শাবান মাস।’ (মুসনাদে আহমাদ-২৫৫৪৮, সুনানে আবু দাউদ-২৪৩১)
এ হাদিসদ্বয় বলছে, রোজা রাখার জন্য নবী সা:-এর কাছে শাবান মাস সর্বাধিক প্রিয় ছিল, তাই তিনি রমজান মাস ব্যতীত এ মাসেই সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন।
আল্লাহর দরবারে বান্দাদের আমলনামা পেশ হওয়ার মাস শাবান : উসামা বিন জায়েদ রা: বলেন, আমি (একবার) বললাম, আমি আপনাকে কোনো মাসেই এত রোজা রাখতে দেখিনি, শাবান মাসে আপনি যত রোজা রাখেন? এ প্রশ্নের উত্তরে নবী সা: বলেন, ‘শাবান হলো রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাস। এ মাস সম্পর্কে (অর্থাৎ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে) মানুষ গাফেল থাকে। শাবান হলো এমন মাস, যে মাসে রাব্বুল আলামিনের কাছে (বান্দার) আমল পেশ করা হয়। আমি চাই, রোজাদার অবস্থায় আমার আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ হোক।’ (মুসনাদে আহমাদ-২১৭৫৩, সুনানে নাসায়ি-২৩৫৭, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা-৯৮৫৮)
সুতরাং একাধিক ফজিলতের কারণে যেভাবে রমজান মাসকে গুরুত্ব দেয়া হয় এবং পবিত্র মাস হিসেবে আশহুরে হুরুম বা পবিত্র চার মাসকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়, তেমনি সারা বছরের আমলনামা পেশ হওয়ার মাস হিসেবে শাবান মাসকেও যথাযথ গুরুত্ব দেয়া কর্তব্য। আর এই গুরুত্ব দেয়ার উপায় হলো- সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে নেক আমলের প্রতি যতœবান হওয়া। শাবান মাসের অধিকাংশ দিন রোজা রেখে নবী সা: উম্মতকে এই নির্দেশনাই দিয়ে গেছেন।
প্রসঙ্গত, এখানে উল্লেøখ করে দেয়া প্রয়োজন, সহিহ হাদিসে আছে, আল্লাহর দরবারে প্রতিদিন বান্দাদের আমলনামা পেশ করা হয়। দিনের আমলনামা রাতে আর রাতের আমলনামা দিনে পেশ করা হয়। (মুসলিম-১৭৯) এটি হলো প্রতিদিনের আমলনামা। অপর একটি সহিহ হাদিসে আছে, সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমলনামা পেশ করা হয়। (মুসলিম-২৫৬৫) এটি হলো সাপ্তাহিক আমলনামা। আর একবার পেশ করা হয় বাৎসরিকভাবে। সেটি হলো শাবান মাসে। এখানে এর কথাই বলা হয়েছে। (লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃষ্ঠা-২৪৪)
শাবান মাসের রোজা : উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে স্পষ্ট, আল্লাহর দরবারে আমলনামা পেশ করা হবে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে নবী সা: শাবান মাসে সর্বাধিক রোজা রাখতেন। তাই শাবান মাসে অন্যান্য নেক আমলের পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী রোজা রাখার চেষ্টা করা কর্তব্য। কিন্তু রোজা রাখবে শাবান মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত। হাদিসে রমজানের এক দুদিন আগে রোজা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। দলিল : আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘তোমরা কেউ রমজানের একদিন কিংবা দুদিন আগে থেকে সওম শুরু করবে না। তবে কেউ যদি এ সময় সিয়াম পালনে অভ্যস্ত থাকে তাহলে সে সেদিন সওম পালন করতে পারবে।’ (বুখারি-১৯১৪)
লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের ফজিলত : শাবান মাসের একটি ফজিলত হলো- অর্ধ-শাবানের রাত। অর্থাৎ ১৪ শাবান দিবাগত রাত। এ রাতের বিশেষ ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিসে আছে, নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন; এরপর তিনি তার সব সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন, কেবল শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত (এই দুই শ্রেণীকে ক্ষমা করেন না)।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান-৫৬৬৫, শুআবুল ঈমান, বাইহাকি-৩/৩৮২, হাদিস-৩৮৩৩)
এই হাদিসটি নির্ভরযোগ্য ও আমলযোগ্য। ইমাম ইবনে হিব্বান, ইমাম যাকিউদ্দীন মুনযিরী, যাইনুদ্দিন ইরাকি প্রমুখ হাদিস বিশারদ ইমাম হাদিসটিকে নির্ভরযোগ্য বলে মতামত দান করেছেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস-৫৬৬৫, আততারগিব ওয়াত তারহিব-২/১১৮, শরহুল মাওয়াহেব-৭/৪১২)
কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা এলে করণীয় হলো- সেই সময়ে সব গুনাহ থেকে বিরত থেকে নেক আমলের প্রতি যতœবান হওয়া, যেন আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের উপযুক্ত হওয়া যায়।
লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শবেবরাতের) আমল : হাদিসে নববীতে দীর্ঘ নফল নামাজ, দীর্ঘতম সময় সিজদা করার কথা আছে। সুতরাং এ রাতে নফল নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির প্রতি যতœবান হওয়া কাম্য। যেমন নফল নামাজের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকাত করে যত রাকাত সম্ভব পড়তে থাকা, কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা, দরুদ শরিফ পড়া, তওবা-ইস্তিগফার করা, দোয়া করা এবং কিছুটা ঘুমের প্রয়োজন হলে ঘুমিয়ে নেয়া। এমন যেন না হয়, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামাজ জামাতের সাথে পড়া সম্ভব হলো না। খেয়াল রাখতে হবে, ফরজ নামাজে যেন কোনোরূপ শৈথিল্য না হয়। কারণ, ফরজ ইবাদতের গুরুত্ব সর্বাবস্থায় নফল ইবাদতের চেয়ে বেশি। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, অনেক অনির্ভরযোগ্য ওজিফার বই-পুস্তকে এই রাতে নামাজের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে, যেমন- এত রাকাত হতে হবে, প্রতি রাকাতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি, এগুলো ঠিক নয়; বরং স্বাভাবিকভাবে যেকোনো সূরা দিয়ে দুই রাকাত করে নফল নামাজ পড়বে। দ্রষ্টব্য : আল আছারুল মারফুআ, আবদুল হাই লাখনোভী, পৃষ্ঠা : ৮০-৮৫) ( অসমাপ্ত)