যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে এক টুইটে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন লিখেছিলেন, ‘দারুণ খবর! কমলা হ্যারিসকে আমি রানিং মেট করেছি।’ খবরটি যে আসলেই দারুণ ছিল, বোঝা গেল গত ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নতুন ইতিহাস রচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর সে ইতিহাস হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নারীর এগিয়ে যাওয়ার জয়গান। কারণ কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হলেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি বড় পদের একটিতে কোনো নারী নির্বাচিত হতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী স্পিকার হন ন্যান্সি পেলোসি। বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর ৮ নভেম্বর ডেলাওয়ারের উইলমিংটনের বিজয় মঞ্চ থেকে দেয়া ভাষণে কমলা বলেন, ‘হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে আমিই প্রথম নারী। কিন্তু আমিই শেষ নই।’ তিনি শিশু বিশেষ করে প্রতিটি মেয়ে শিশুকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমাদের দেশ তোমাদেরকে পরিষ্কার বার্তাই দিয়েছে, তোমরা স্বপ্ন দেখো, দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাও।’
সত্যিই, যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের এগিয়ে যাওয়ারই এক গল্প! যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা প্রথম ভোটাধিকার পেয়েছিল ১৯২০ সালে। ঠিক ১০০ বছর আগে। আর ১০০ বছর পর, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দুই পদের একটিতে প্রথম নিজেদের প্রতিনিধি পেলেন নারীরা। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ন্যান্সি পেলোসি প্রথম নারী স্পিকার হয়েছেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ছিলেন। ১৯৮৭ সালে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হন তিনি। বারাক ওবামার সময় থেকে তিনি স্পিকার। কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটিক আইনপ্রণেতারা বৃহস্পতিবার তাকে আবার দুই বছরের জন্য প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার হিসেবে মনোনীত করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। বয়স ৮০ বছর। এ অর্জনের জন্য নারীদের যেমন দীর্ঘ প্রতীক্ষা, তেমনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এর আগে ১৯৮৪ সালে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ওয়াল্টার মন্ডেলের সাথে প্রথম নারী হিসেবে জেরাল্ডিন ফেরারোকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করা হয়। তবে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ২০০৮ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন ম্যাককেইনের সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দেয়া হয়েছিল আলাস্কার নারী গভর্নর সারাহ পলিনকে। তিনিও ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রথম নারী প্রার্থী হন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু ৩০ লাখ পপুলার ভোট বেশি পেয়েও ট্রাম্পের কাছে ইলেকটোরাল ভোটে হেরে যান হিলারি। এবার কমলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে এ কথাই জানান দিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিতে নারীরা আর হেলাফেলার বিষয় নয়। এর আগে নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মেডিলিন অলব্রাইট। প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কন্ডোলিজা রাইস। ওবামা প্রশাসনে দাপুটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন হিলারি ক্লিনটন। ওবামা প্রশাসনে আরো দু’জন নারী মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন- জেনেট ন্যাপোলিটানো ও হিন্ডা সলিস হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও শ্রমবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। প্রেসিডেন্ট পদে ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন জিততে পারেননি, এ কথা ঠিক। তবে ২০১৭ সালে রেকর্ডসংখ্যক নারী আমেরিকার সিনেটে প্রবেশ করেন। অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতা নারীর সংখ্যা আরো বেশি। ২০১৭ সালে এক হাজার ৮৩০ জন নারী ৫০টি অঙ্গরাজ্যের আইনসভায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া ৩০ হাজারের বেশি জনসংখ্যার শহরগুলোর ২০ শতাংশ মেয়র পদে আসীন হন নারী। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক ৯৮ জন নারী প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ৩২২ জন নারী যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে দায়িত্ব পালন করেন। এদের মধ্যে ২০৮ জন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এবং ১১৪ জন রিপাবলিকানদের। এবারের নির্বাচনে কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নারীদের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, কমলা যুক্তরাষ্ট্রের নারী ভোটারদের মধ্যে শক্তির সঞ্চার ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে কমলাকে নিয়ে বেশি মাতামাতি হয়েছে। আইনজীবী থিয়োডোরা এএফপিকে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, কমলা মেয়েদের কাছে একজন বিস্ময়কর রোল মডেল। জো বাইডেন তার মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী করতে যাচ্ছেন একজন নারী, মাইকেল ফ্লাওয়ারজয়কে। এটাও হবে নতুন ইতিহাস। ভারতীয় মা ও জ্যামাইকান বাবার মেয়ে কমলা হ্যারিস আমেরিকার রাজনীতিতে প্রবেশের পর ২০০৩ সালে প্রথমবার নির্বাচনে যেতেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হন। ২০১০ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হন। আর ২০১৬ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর নির্বাচিত হলেন। দুই অভিবাসীর সন্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
জীবনীগ্রন্থ ‘দ্য ট্র্রুথ উই হোল্ড’ বইয়ে কমলা হ্যারিস লিখেন, কমল অর্থ পদ্মফুল, যা ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাৎপর্যের প্রতীক। সেখান থেকেই নেয়া হয়েছে ‘কমলা’ নামটি। মা শ্যামলা গোপালন ভারতের তামিলনাড়– থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ক্যান্সার গবেষক ও অধিকারকর্মী। বাবা ডোনাল্ড হ্যারিসের জন্ম জ্যামাইকায়। তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এই দুই অভিবাসীর সন্তান হিসেবে তার জন্ম হয় ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্ডে। পাঁচ বছর বয়সে মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। মায়ের কাছে কমলা ও তার বোন মায়া বেড়ে ওঠেন মিশ্র সংস্কৃতিতে। তারা মায়ের সাথে ভারতেও বেড়াতে এসেছেন। তবে মা জানতেন, বসবাসের জন্য তিনি যে দেশটা বেছে নিয়েছেন, সে দেশের জনগণ কমলা ও মায়াকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই গ্রহণ করবে। মা সেই সংস্কৃতিতেই আমাদের গড়ে তোলেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘কৃষ্ণাঙ্গদের বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে পরিচিত, হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে তাকে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেখানে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় পড়েছেন আইন বিষয়ে। তবে জীবনে গঠনমূলক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৯ সালে মা শ্যামলা মারা যান। ২০১৪ সালে কমলা বিয়ে করেন আইনজীবী ডগলাস এমএফকে ভারতীয় ও ইহুদি ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে। বাইডেনের সাথে সুর মিলিয়ে কমলাও ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। বাকপটু কমলা হ্যারিস বলেন, ‘বাইডেন ও আমি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখতে প্রস্তুত। প্রথম দিন থেকেই অর্থনীতি পুনর্গঠনে আমরা কাজ শুরু করতে যাচ্ছি, যা কর্মজীবী পরিবারগুলোর জন্য কাজে দেবে।’ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব