রংপুর অঞ্চলীয় পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে গঠিত ‘করতোয়া ভ্যালি’ অর্থনৈতিক অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে চা খাত।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের (বিটিবি) কর্মকর্তারা জানান, ভ্যালিতে চলমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে ‘ক্ষুদ্র পরিসরে উদ্যান ভিত্তিক’ চা চাষ সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে। রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার সমন্বয়ে গঠিত ভ্যালিতে চলতি বছর চা উৎপাদন এক কোটি কেজির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা জানান, এখানে চা উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার কেজি।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মোহাম্মদ শামিম আল মামুন চা চাষ সূত্রপাতের ইতিহাস তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘করতোয়া ভ্যালিতে’ এর উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ‘১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরকালে জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পঞ্চগড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা চারা রোপণ শুরু করেন। বিটিবির সায়েন্টিস্টরা ১৯৯৯ সাল থেকে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে চা চাষের সম্ভাব্যতা নিয়ে ভালো ফলাফলের জন্য গবেষণা চালিয়েছেন এবং বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের জন্য ১৬ হাজার হেক্টর জমি খুঁজে পেয়েছেন।
শামিম বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় তেঁতুলিয়া চা কোম্পানি লি. (টিটিসিএল) বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করেছে। টিটিসিএলের সাফল্য কৃষিক্ষেত্রে চাষাবাদ বিহীন এ অঞ্চলে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। এই জেলাগুলোর স্থানীয় কৃষকরা ভ্যালিতে ‘ক্ষুদ্র পরিসরে উদ্যান ভিত্তিক’ চা চাষ শুরু করেছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৯ জন নিবন্ধিত ১৯ জন অনিবন্ধিত ও ৬ হাজার ৫৫৮ জন ক্ষুদ্র মালিকানায় চা চাষের আওতায় ভ্যালিতে ৮ হাজার ৬৮০ একর জমিতে চা চাষ করে ৪ কোটি ৬৯ লাখ কেজি গ্রিন টি পাতা উৎপাদন করেছেন। ২০১৯ সালে উৎপাদিত গ্রিন টি পাতা ১৮টি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি প্রক্রিয়াকৃত চা উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রক্রিয়াকৃত চা এক কোটি কেজির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াতে পারে। ২০১৫ সালে বিটিবি ‘এক্সপ্যানসন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন নর্দান বাংলাদেশ প্রজেক্ট’ এর মাধ্যমে ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে চা চাষ শুরু করে।
উদ্দেশ ছিলো ২০২০ সালের মধ্যে ভ্যালিতে ৫ শতাধিক হেক্টর আবাদ অযোগ্য জমিকে চা চাষের আওতায় নিয়ে আসা। ‘ক্ষুদ্র পরিসরে উদ্যান ভিত্তিক’ চা চাষ সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে এবং সেইসঙ্গে প্রতিবছর হাজার হাজার চা শ্রমিকের কর্মসংস্থান বাড়ছে বিশেষ করে নারীদের।’
এদিকে দরিদ্র পীড়িত রংপুর বিভাগে তামাক চাষের পরিবর্তে শুরু নতুন আশার আলো চা চাষ। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীর পাশাপাশি রংপুর, লালমনিরহাটও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়েছে। এ সব এলাকায় চা চাষের আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার একর। রংপুর জেলার তারাগঞ্জ ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলাসহ রংপুর বিভাগের ভিন্ন এলাকায় পরিত্যক্ত ও উঁচু জমিতে চা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। এতে ওই এলাকার চাষিদের মাঝে অর্থনৈতিক উন্নতিতে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে চা চাষিরা।
আর এই অঞ্চলে চা চাষের পথ দেখিয়েছে, রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী গ্রামে অবস্থিত সিনহা এগ্রো বেইজড ইন্ডাষ্ট্রিজ নামের একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। দেশে চা পাতার চাহিদা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের উদ্যোগ নেয় সিনহা এগ্রো বেইজড ইন্ডাষ্ট্রিজ।
২০১৫ সালের জুন মাসে রংপুরের তারাগঞ্জ ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার পরীক্ষমূলকভাবে চা চাষের উদ্দেশ্যে চারা গাছ লাগানো হয়। চারাগাছগুলো চা পাতা সংগ্রহের উপযোগী হওয়া পর্যন্ত সময় লাগে এক বছর। এক বছরে দেড় একর জমিতে ব্যয় হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। এক বছর পর এ বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয় প্রায় ৩’শ ২২ কেজি চা পাতা। যার মূল্য আসে প্রায় ১০ লাখ ৩ হাজার ১‘শ ৬৮টাকা। এরপর পর্যায়ক্রমে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে তারাগঞ্জ উপজেলায় একটি ও এর পার্শ্ববর্তী নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলায় বাহাগিলি ও দুরাকুঠিতে দুটি বাগান রয়েছে। এরমধ্যে উপজেলায় বাহাগিলিতে রয়েছে ৭ একর এবং দুরাকুঠিতে টি-প্লান্টেশন রয়েছে ১৯ একর ও চা বাগান রয়েছে ২ একর জমিতে। এই ৩টি চা বাগান থেকে প্রতি বছর ৯ থেকে ১০ বার রাউন্ড দিয়ে চা পাতা সংগ্রহ করা হয়। প্রতি রাউন্ডে চা পাতা সংগ্রহ করা হয় যার প্রতি কেজি ২০ টাকা। আর প্রতি কেজি চা বিক্রয় করা হয় ৩২ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। আর এ চা পাতা বিক্রয় করে পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাষ্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। কয়েক বছর আগে রংপুর অঞ্চল তামাক চাষের জন্য খুবই সুখ্যাতি ছিল। এখন তামাক চাষে কৃষকরা নিরুৎসাহিত। ওই জমিগুলোতে তৈরি হয়েছে চা বাগান।
বাংলাদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন বলেন, রংপুর বিভাগের রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে চা চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ সব এলাকার আবাদি জমির পরিমাণ ৬ হাজার একর।
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র চা বাগান আটটি আর মাঝারি ১২টি, এতে ৩ হাজার চাষি চা চাষের সঙ্গে জড়িত। কারখানা রয়েছে ১৩টি। প্রতি বছর প্রস্তুতকৃত চায়ের পরিমাণ ৮০ লাখ কেজি। তিনি আরও বলেন, কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ হয় চলতি বাজারের ওপর। ফলে চা বাগান মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তিনি সরকারকে সরাসরি চা বাগান মালিকদের নিকট থেকে ক্রয় করার আহ্বান জানান। কথা হয় সিনহা এগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রিজের টি গার্ডেনের ম্যানেজার রিফাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামের বরাতির ব্রিজের পাশে প্রায় দেড় একর জমি চা বাগান এবং নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলির ৭ একর জমিতে চাষকৃত চা বাগান ঘুরে দেখান।
এ সময় জানান, আমাদের প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা উৎপাদন শুরু করেন। আর এর সমস্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় আমার ওপর। এই উপজেলায় চা বোর্ডে কোনো অফিস নেই। ফলে আমি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত চা বোর্ডেও অফিসে যোগাযোগ করি। তারা আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তারাগঞ্জের বালাপাড়া এবং কিশোরগঞ্জের বাহাগিলি ও দরাকুঠির এলাকায় সিনহা এগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রিজের চায়ের চাষ দেখে অত্র অঞ্চলের যুবকরা এখন চা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন বলেন, রংপুর বিভাগের রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে চা চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ সব এলাকায় আবাদি জমির পরিমাণ ৬ হাজার একর।
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র চা বাগান ৮টি আর মাঝারি ১২টি, এতে ৩ হাজার চাষি চা চাষের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তাদের কারখানা রয়েছে ১৩টি। প্রস্তুতকৃত চায়ের পরিমাণ ৮০ লাখ কেজি। তিনি আরও বলেন, কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারিত হয় বাজারের ওপর। ফলে চা বাগান মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি সরকারকে সরাসরি চা বাগান মালিকদের নিকট থেকে চা পাতা ক্রয় করার জন্য আহবান জানান।
রংপুর চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরি টিটু বলেন, রংপুর এগ্রোবেজ এলাকায় যে চায়ের চাষ শুরু হয়েছে তার গুনগত মান অত্যন্ত ভালো। ভারতের দারজিলিং এর চায়ের তুলনা করা যেতে পারে। চা শিল্পের সঙ্গে বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চা চাষের জন্য সম্প্রসারণ করা যায় তাহলে মঙ্গা কবলিত বৃহত্তর রংপুরের বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন হবে। তিনি সরকারের চা বোর্ডকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তিনি আরো বলেন, বেকারদের প্রশিক্ষণও বিনা সুদে ঋণ প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।
রংপুর অঞ্চল বিভাগ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক খন্দকার আব্দুল ওয়াহেদ জানান, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার মধ্যে রংপুরও লালমনিরহাট ও নীলফামারীর জেলায় চা চাষ হচ্ছে। চায়ের ফলনও বাম্পার হয়েছে। এ অঞ্চলের যে জমিতে ভালো ফসল ফলে না ওই জমিতে চা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পরিত্যক্ত জমিতে চা চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন চা চাষিরা। এই তিন জেলায় সরকারি হিসেবে প্রায় ৪০ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। চা চাষের প্রসারতা বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তিন আরো জানান, চা চাষের কারণে এ অঞ্চলের তামাক চাষ প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমি থেকে ১২ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে।-ইত্তেফাক অন লাইন